ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫, ১৩ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্বাধীনতার ৫৫ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সমস্যা ও করণীয়

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
স্বাধীনতার ৫৫ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সমস্যা ও করণীয়

আগামীকাল বুধবার ৫৫তম মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস ২০২৫। তার মানে আমরা স্বাধীন দেশ হিসেবে ৫৪টি বছর পার করে ফেলেছি। এই সময়ে আমাদের অর্জন, সফলতা ও বিফলতা হিসেব কষার জন্য যথেষ্ট কি না! আমরা যদি এখনো বলি নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ বা স্বাধীনতার খুব বেশি সময় পার করিনি সেটা বলার আর যৌক্তিকতা রয়েছে বলে মনে করি না। স্বাধীন দেশের মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্য মুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা। সকল নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী ও আইনের চোখে সমান থাকবে। সংবিধান ও দেশের আইন কানুন অনুযায়ী রাজনীতি করার সমান সুযোগ-সুবিধাসহ ভোটের ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকবে ও সাথে মৌলিক মানবাধিকার সুন্দরভাবে উপভোগ করবে দেশের প্রতিটি নাগরিক। আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য হলো স্বাধীনতার ৫৪ বছরে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে যা যা পাওয়ার কথা ছিল বা যতটুকু উন্নয়ন ও উন্নতি সাধন হওয়ার কথা ছিল তা হয়েছে কি না বা এ বিষয় বর্তমান প্রজন্ম ও মুরব্বিদের ভাবনা ইতিবাচক না নেতিবাচক তা খতিয়ে দেখা। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনা, সীমাবদ্ধতা এবং অনিয়মের শিকার। স্বাধীনতার ৫৪ বছরের বেশি সময় পরও দেশের জনগণ একটি কার্যকর এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রবেশযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার অভাবে ভুগছে। এমনকি স্বাস্থ্য খাতের মৌলিক কাঠামো উন্নত করতে কোনো সরকারই এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এ অবস্থায়, দেশের চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়ন, সুষ্ঠু নজরদারি, এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সক্রিয় ভূমিকা জরুরি। স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান সমস্যা ও সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে বিষয়টি তাদের নজরে আনার জন্য এই লেখাটি প্রণয়ন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর মধ্যে একটি হলো বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং। চিকিৎসা সরঞ্জাম উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় এ শাখার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান বুয়েটসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর অসংখ্য বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার গ্র্যাজুয়েট করলেও, তাদের অধিকাংশই দেশের সেবা না করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। (এটা অবশ্যই নিঃসন্দেহে লক্ষণীয় শুধুমাত্র বায়োমেডিকেল শিক্ষার্থী নয় ডাক্তারসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। শুধু কি তাই? অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার পড়ার পর বিসিএস ক্যাডার হয়ে অন্য পেশার চলে যাচ্ছে। কারণ জানা সত্ত্বেও প্রতিকার নেই)!

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে শিক্ষার্থী তৈরি করার পরেও যদি তারা দেশের জন্য কাজ না করে, তাহলে সেই বিনিয়োগ কতটুকু কার্যকর? দেশের মেধা এবং দক্ষতাকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারের উচিত :

১. দেশীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম উন্নয়নে বিনিয়োগ করা। ২. উচ্চ বেতন ও গবেষণার সুযোগ দিয়ে মেধাবীদের ধরে রাখা। ৩. স্থানীয় শিল্পায়নে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারদের ভূমিকা নিশ্চিত করা। এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।

এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং শুধুমাত্র অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কাল নয়, বরং ভবিষ্যতেও রাষ্ট্রের সকল সেক্টরে এর সুফল কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হতে হবে। সরকারের পরবর্তী পর্যায় বা রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও, স্বাস্থ্য খাতসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের কার্যক্রম সুস্থভাবে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হতে হবে। সঠিক দিকনির্দেশনা, কার্যকরী নীতিমালা এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম যেন কখনো থেমে না যায়, এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার।

প্রাইভেট হাসপাতালের অনিয়ম ও নজরদারির অভাব: সম্প্রতি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার, অপারেশন থিয়েটারে সংবেদনশীল চিকিৎসা ডিভাইস পুনঃব্যবহার এবং ওষুধের তারিখ ঘঁষে মুছে ফেলার মতো অমানবিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। এসব ঘটনা শুধু রোগীদের জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়, বরং দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা চূর্ণ করছে। দেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে নিয়মতান্ত্রিকতার অভাবের ফলে নৈতিক অবক্ষয় বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালের সীমাবদ্ধতার কারণে ৬৫ শতাংশ রোগীকে প্রাইভেট সেবা নিতে হয়। অথচ এসব সেবার মান ও খরচের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।

এক্ষেত্রে করণীয় : ১. প্রাইভেট হাসপাতালের কার্যক্রমের ওপর স্বাধীননিয়ন্ত্রক সংস্থার তত্ত্বাবধানে নজরদারি নিশ্চিত করা। ২. মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার বা চিকিৎসায় গাফিলতির জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। ৩. প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয়কে সীমাবদ্ধ রাখতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা।

সরকারি হাসপাতালের সীমাবদ্ধতা ও করণীয় : সরকারি হাসপাতালগুলোর অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং জনবল সংকট দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যতম বড় সমস্যা। গ্রামাঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের অভাব এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা সাধারণ মানুষের জন্য মানসম্পন্ন চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। এছাড়া, দেশের বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালের মূল্যবান সরঞ্জামগুলো দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাবে অকার্যকর অবস্থায় পড়ে থাকে। চিকিৎসা সরঞ্জামের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ জনবল এবং পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন।

প্রস্তাবিত পদক্ষেপ : ১. সরকারি হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি। ২. আধুনিক যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান নিয়োগ। ৩. গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসাসেবা সম্প্রসারণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ।

চিকিৎসা ব্যবস্থায় নৈতিকতার অবক্ষয় : বর্তমানে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নৈতিক অবক্ষয় চরমে পৌঁছেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার এবং অপারেশন থিয়েটারে দুর্নীতির মতো ঘটনা প্রমাণ করে, চিকিৎসা সেবা অনেক ক্ষেত্রে মানবিক দায়িত্বের পরিবর্তে ব্যবসায়িক মানসিকতায় পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি অভিজিৎ নামক এক ছাত্রের ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে মৃত্যুর ঘটনাও চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং ত্রুটিগুলোকে সামনে এনেছে। এ ধরনের ভুল চিকিৎসা এবং গাফিলতি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।

এই অবক্ষয় রোধে প্রয়োজন : ১. চিকিৎসা সেবাকে মানবিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা। ২. চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে নৈতিকতার চর্চা নিশ্চিত করা। ৩. চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা।

বিদেশমুখী চিকিৎসা ও বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় : বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতার কারণে শুধু বিত্তশালী জনগণই নয়, সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাগণও চিকিৎসার জন্য ভারতের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশে ছুটে যাচ্ছেন। এটি প্রশ্ন তৈরি করে—সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কি জানেন দেশের স্বাস্থ্য খাতের বাস্তব অবস্থা? তারা কি জানেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো কতটা দুর্বল এবং এর উন্নয়নের জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে? কিংবা, তারা কি অবগত যে, চিকিৎসার নামে জনগণের যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে, তা দেশের অর্থনীতির ওপর কতটা বিরূপ প্রভাব ফেলছে? এটি শুধু সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ নয়, বরং একটি জাতীয় সংকটের ইঙ্গিত। যদি এসব বৈদেশিক মুদ্রা দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করা যেত, তবে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক বেশি উন্নত হতো এবং আমাদের জনগণ দেশেই উন্নত চিকিৎসাসেবা পেতে পারতেন। অথচ এই বিপুল অর্থ বিদেশে চলে যাওয়ার কারণে আমাদের অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে এবং জনগণকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নির্ভরশীল করে তুলছে।

অনতিবিলম্বে পদক্ষেপের প্রয়োজন : দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতাগুলোর সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। এই লেখায় উত্থাপিত সমস্যাগুলো এবং প্রস্তাবিত সমাধানগুলো স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নজরে এনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন জানানো হলো। আশা করা যায়, এটি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে। এজন্য, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও আন্তরিক উদ্যোগ অপরিহার্য। আগামী দিনে যে কোনো সরকারই, এই অবকাঠামোগত ও নৈতিক পরিবর্তনগুলো রূপায়ণ করার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসবে এবং জাতির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে- এটি আমাদের দৃঢ় প্রত্যাশা।

পরিশেষে বলতে চাই, গত ৫৪ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অভিযোগ হচ্ছে ‘অব্যবস্থাপনা’। সত্যিকার অর্থেই দেশে পেশাদার একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। তৃণমূল থেকে যত ওপরে যাওয়া যায় সর্বত্রই একই দৃশ্য প্রতীয়মান হয়।

আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হচ্ছে, জিডিপির পাঁচ শতাংশের মতো অর্থ স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ দেয়া। বাংলাদেশে এক যুগের অধিককাল ধরে বাজেটে জিডিপির এক শতাংশের কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থেরও কম-বেশি ৭০ শতাংশ বেতন-ভাতা ইত্যাদির মতো খাতে খরচ হয়। বাকি অর্থ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে ব্যবহৃত হওয়ার কথা, যা নিতান্তই অপ্রতুল। স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়নের কথা ভেবে এ খাতের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে এ অর্থের সর্বোচ্চ সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে।

সেজন্য প্রয়োজন নিয়মিত গবেষণা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ।আর স্বাস্থ্যসেবার মধ্যেই সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চাই। অন্যকে সম্মান করার মানসিকতা আরও সমৃদ্ধ হোক। ভিন্নমতকে সম্মান জানানোর সংস্কৃতি আরও ইতিবাচক হোক। বৈষম্যের অবসান হবে সব ক্ষেত্রে এরকম স্বপ্ন দেখি হরহামেশা। মৌলিক চাহিদাগুলো যেমন- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, কর্মস্থানের সুবিধা প্রতিটি নাগরিক সমানভাবে পাক। হিংসা-বিদ্বেষ ও ঈর্ষার অবসান হোক। স্বাধীনতার চেতনার পূর্ণ জয় হোক।

লেখক : সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক। প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত