ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫, ১৩ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যক্ষ্মারোগ : প্রতিরোধ ও প্রতিকার

আফতাব চৌধুরী
যক্ষ্মারোগ : প্রতিরোধ ও প্রতিকার

প্রাণঘাতী ব্যাধি ক্যান্সার যে শুধু রোগীকে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা নয়। তার মানসিক চাপটাও বাড়িয়ে দেয় অনেকটা। এ কথা আমরা সবাই জানি যে ক্যান্সার রোগীর বাড়ির লোকেরাও বাদ পড়েন না এই মানসিক চাপের হাত থেকে। রোগীকে সুস্থ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তারাও। ক্যান্সারের মতো যক্ষ্মারোগ (টিবি) আজও কেড়ে নেয় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। আর একজন যক্ষ্মা রোগীর মানসিক চাপ; কিন্তু ক্যানসার রোগীর থেকেও অনেক গুণ বেশি। কারণ, সমাজ এখনও যক্ষ্মারোগীকে দূরে সরিয়ে রাখে।

যক্ষ্মারোগীর জীবনে বয়ে নিয়ে আসে সীমাহীন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক চাপ। ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে এখনও যক্ষ্মারোগীর সংখ্যাটা খাতায় কলমে ঠিক কত তা জানা যায় না। আর এই বেহিসাবি রোগীর সংখ্যাটাই এখন যক্ষ্মারোগ নিরাময়ের পথে অন্যতম প্রধান বাধা। যদিও বাংলাদেশ সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, চিকিৎসক যক্ষ্মারোগীর চিকিৎসা করার সময় প্রথমেই তাকে নথিভুক্ত করাবেন সংশোধিত যক্ষ্মারোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তালিকাতে। কিন্তু আইন থাকলেই বা কী? তেমনটা আর হচ্ছে কোথায়?

আসলে যক্ষ্মারোগীর সঠিক সংখ্যাটা ঠিক কত সেটাও যেমন জানা যায় এই তালিকা থেকে তেমনই জানা যায় সুস্থতার হারও। বাংলাদেশে যক্ষ্মারোগ নির্মূল করতে এই গণনার উপকারিতা তাই প্রশ্নাতীত। বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে আমাদের দেশ হবে যক্ষ্মামুক্ত। আর তাই এই রোগকে সমূলে বিনাশ করতে পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছিল; কিন্তু বাস্তবে ততটুকু ফল পাওয়া যায়নি যতটুকু আশা করা হয়েছিল। তবে প্রয়াস অব্যাহত আছে।

কফ এবং কাশি হচ্ছে যক্ষ্মার প্রধান লক্ষণ। প্রাথমিক অবস্থায় কাশি, কফ এবং সামান্য জ্বর দিয়ে ব্যাধিটির শুরু হয়। ধীরে ধীরে আরো নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন- খাবারে অনীহা, শরীরের ওজন অল্প অল্প করে হ্রাস পাওয়া, বিষাদগ্রস্ততা, মাঝে মাঝে রাতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়া ইত্যাদি। কোন কোন যক্ষ্মা রোগীর কফ বা কাশির সঙ্গে রক্ত নির্গত হয়। কফের সাথে যে রক্ত বের হয় তা খুব বেশি লাল হয়ে থাকে। যক্ষ্মা রোগীদের রোগের শুরুতে যে জ্বর হয় তা সাধারণত বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে থাকে; কিন্তু সকালের দিকে আর রোগীর জ্বর থাকে না। কোন ব্যক্তির কাশি যদি দুই থেকে তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় স্থায়ী হয়, তবে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের নিকট যেতে হবে। এ রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা গেলে সুষ্ঠু চিকিৎসার দ্বারা যক্ষ্মা সম্পূর্ণ ভালো করা সম্ভব। যক্ষ্মা বা টিবি রোগীদের নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সাধারণত কফ পরীক্ষা করে থাকেন। কফের সাথে যক্ষ্মার জীবানু পাওয়া গেলে তারা এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত হন। যক্ষ্মার জীবাণু খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, কফ, থুথু থেকে নির্গত জীবাণু সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দেহে প্রবেশ করে যক্ষ্মা রোগটি সংক্রমিত করে থাকে।

এছাড়াও রোগটি ব্যবহৃত জিনিসপত্রের দ্বারা যক্ষ্মা সংক্রমিত হয়।

যক্ষ্মা বা টিবি হলে এখন আর আতঙ্ক বা দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। ডাক্তার এবং রোগীর সমন্বিত প্রচেষ্টা দ্বারা যক্ষ্মার হাত থেকে রোগীকে মুক্ত করা সম্ভব। এ ব্যাধিটির চিকিৎসককে সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি রোগীর ধৈর্য ধরে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। অন্যান্য ব্যাধির চিকিৎসার চেয়ে যক্ষ্মার বা টিবি’র চিকিৎসা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। ৬ মাস, ৯ মাস, ১২ মাস, এবং ১৮ মাস পর্যন্তও এর চিকিৎসা হয়। চিকিৎসককে রোগীদের এ রোগ সম্পর্কে ভালো করে ধারণা দিতে হবে, যাতে তারা ভীত বা আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ সঠিকভাবে গ্রহণ করে। অনেক রোগী কিছু দিন ওষুধ সেবন করার পর একটু সুস্থ হতে শুরু করলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। এ কাজটি করলে রোগীর যক্ষ্মা বা টিবি অয়াবহ আকার ধারণ করে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্টেন্ট টিবির দিকে মোড় নেয়। ডাক্তার যখন রোগীকে প্রেসক্রিপশন দেবেন, তখন রোগীকে খুব ভালো করে ওষুধ সেবনের নিয়ম বুঝিয়ে দিতে হবে। কখনও কখনও ওষুধ খাবার পর রোগীর দেহে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে, সেক্ষেত্রে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যক্ষ্মা রোগীদের হাঁচি এবং কফের দ্বারা দ্রুত জীবাণু সংক্রামত হয়।

তাই সুস্থ ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। এছাড়াও সুস্থ ব্যক্তিদের যে সকল বিষয়ের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে তাহল- বদ্ধ ঘরে থাকা যাবে না। আলো-বাতাসযুক্ত জায়গায় বসবাস করতে হবে। যে সমস্ত টিবি রোগীর কফের সাথে টিবি’র জীবাণু রয়েছে, তাদের যেখানে সেখানে কফ ফেলা পরিহার করতে হবে। এ সকল রোগীর অবশ্যই করণীয় যেটা সেটা হচ্ছে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা।

উপযুক্ত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যক্ষ্মার চিকিৎসা পদ্ধতি খুব বেশি ব্যয়বহুল নয়। এ রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময়ের একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে পূর্ণমেয়াদে ওষুধ সেবন করা। তাই অবহেলা না করে সঠিক নিয়মে কয়েক মাস বিরতিহীন চিকিৎসা গ্রহণ ও ওষুধ সেবন করতে হবে। তবেই সকল মানুষকে যক্ষ্মা বা টিবির অভিশাপ থেকে রক্ষা করা সম্ভবপর হবে।

দুঃখের বিষয়, যক্ষ্মারোগীর সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারেন না। আমরা জানি যে, বিশ্বের মোটা যক্ষ্মারোগীর মধ্যে ৫ শতাংশই বাংলাদেশে। কিন্তু দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল এমনই যে অনেক সময় সময়মতো ধরা পড়ে না যক্ষ্মার জীবাণু। ধরা পড়লেও কখনও আবার সরকারি খাতায় নথিভুক্ত করানো হয় না রোগীর পরিচয়। চোখে না দেখা গেলেও এই করাল ব্যাধি যে সমাজে আছে তা অস্বীকার করা যায় না। সংখ্যাতত্ত্বে এই অস্বচ্ছতার কারণে অনেক সময়ই নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা যক্ষ্মারোগীকে জীবনদায়ী পরিষদে পৌঁছে দিতে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয় খোদ সরকারকে। ফলে অধরা থেকে যায় রোগী এবং তার রোগ। বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারান মানুষ।

যক্ষ্মারোগীর পরিবারকেও সম্মুখীন হতে হয় অনেক ভোগান্তির। রোগীকে এবং তাঁর পরিবারকে একঘরে করে দেয় সমাজ। মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে অনেকেই আবার শিকার হন ডিপ্রেশনের। কখনও কখনও মানসিক রোগগ্রস্ত যক্ষ্মারোগীর জীবন দীর্ঘদিন অবহেলা সহ্য করে এইচআইভি রোগীর থেকেও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। মহিলা- যক্ষ্মারোগীর জীবন তো আরও কষ্টের। স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকেও বহু মহিলার কাছেই তা অধরা। বাড়ির লোকের অবহেলার সঙ্গে তার জন্য অপেক্ষা করে সমাজের রক্তচক্ষু এবং নির্যাতন।

নানা সংস্থায় সেবামূলক কাজ করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, রোগীর পারিপার্শ্বিক মানুষরা এবং স্থানীয় সংগঠনই পারে রোগীকে প্রকৃত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। তাঁর মানসিক চাপ কমাতে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ভারতের মালায়ুর একটি সংগঠনের কথা।

এইচআইভি রোগীদের নিয়ে কাজ করে একটি সংস্থা, যক্ষ্মারোগী ও তাঁদের বাড়ির লোকদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি ক্লাব; টিবি ক্লাব। যেখানে বিভিন্ন ছোটো বড় কর্মসূচি ও আলোচনা সভার মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হয় পরস্পরের সগযোগিতা, সঠিক চিকিৎসার সঙ্গে কাছের মানুষের কাছে ভালো ব্যবহার পাওয়াটাও কতটা জরুরি রোগীর জীবনে।

ভারতের বিহারে মহিলা-পরিচালিত একটি সংস্থার উদ্যোগে প্রতি মাসে একত্রিত হন সদস্যরা। সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা ছোটোবড়ো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে। সেই সভাতে আলোচনা হয় যক্ষ্মারোগ নিয়েও। মহিলার ওই দল মেয়েদের যক্ষ্মারোগ নিয়ে আলোচনা করে। কী কী উপসর্গ দেখলেন বোযা যাবে, যে যক্ষ্মা হয়েছে বা কখন যেতে হবে চিকিৎসকের কাছে বা অন্য যে কোনো রোগীর মানসিক চাপ কমাতে কী কী করতে হবে- সব কিছু নিয়েই খোলামেলা আলোচনা হয় সে সভায়।

এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তাদের মধ্যে একটি আশার আলো জাতীয় কৌশলগত কর্মসূচি। এই নতুন প্রকল্পই সব সামাজিক বাধা অতিক্রম করে রোগীকে জোগাবে বাঁচার আশা। সাহায্য করবে চিকিৎসার প্যাকেজও। এই কর্মসূচিতেই মিলবে কাউন্সেলিংয়ের সুবিধা। সমাজের মানুষকে নিয়েই নেয়া হবে নতুন নতুন উদ্যোগ যা দূর করবে যক্ষ্মারোগীর মানসিক উদ্বিগ্নতা। নতুন এই জাতীয় কর্মসূচি অনুযায়ী, সবার মিলিত প্রচেষ্টাতেই আমরা পেতে পারি দুরারোগ্য ব্যাধি যক্ষ্মার প্রাণনাশী ভোগান্তি এবং দারিদ্রের মতো সমস্যা থেকে মুক্তি। সঠিক যত্ন এবং চিকিৎসাই পারে সমাজ থেকে যক্ষ্মার প্রকোপকে দূর করতে। কারণ সঠিক সেবা এবং যত্ন একে অপরের উপর নির্ভরশীল।

ঠিক যেমন সঠিক পুষ্টির অভাব একজন রোগী চিকিৎসায় সাড়া দিতে পারেন না; ঠিক তেমনই করাল ব্যাধি যক্ষ্মার সঙ্গে মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রচণ্ড মানসিক চাপে একঘরে হয়ে যাওয়া রোগীও একটি একটু করে চিকিৎসা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান। যক্ষ্মারোগের চিকিৎসার জন্য এখন সব থেকে বড়ো বাধা ওষুধ প্রতিরোধক (ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স)। মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স যক্ষ্মা নিরাময় এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তার থেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স যক্ষ্মাকে মোকাবিলা করা। তবে এই দুটিকে একসঙ্গে মোকাবিলা করা কঠিন এবং খরচ সাপেক্ষ।

দিনের পর দিন পেয়ে থাকা অসহায়তা এবং যন্ত্রণা রোগীর কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। আর সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি নিজের মানসিক ক্ষতি। এর মধ্যে আবার অনেকে বলতেই পারেন, সঠিক চিকিৎসা এবং পরিমিত আহার থেকে রোগী পেতে পারেন মানসিক ও সামাজিক শান্তি। তাদের আমি বলতে চাই রোগীর যত্ন এবং যক্ষ্মা প্রতিরোধ আলাদা আলাদা দুটি বিষয় নয়। এ কথা আমরা বুঝতে পারলেই আমরা কমাতে পারব যক্ষ্মারোগীর কষ্ট। সেই সঙ্গে যক্ষ্মামুক্ত দেশ গড়ে তুলতে পারব।

সাংবাদিক- কলামিস্ট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত