ঢাকা বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে ২৬ মার্চের প্রতিফলন

নন্দিনী লুইজা
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে ২৬ মার্চের প্রতিফলন

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২৬শে মার্চ এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনেই বাঙালি জাতি পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার অমর ঘোষণা দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, যার মাধ্যমে আমরা অর্জন করি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড- বাংলাদেশ। ২৬শে মার্চ তাই শুধু একটি তারিখ নয়, এটি জাতির আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা এবং লালিত স্বপ্নের প্রতীক। তবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর প্রশ্ন উঠে- বর্তমান প্রজন্ম ২৬শে মার্চের মূল চেতনা কতটা ধারণ করতে পেরেছে? স্বাধীনতার মূল্য, আত্মত্যাগ, গণতন্ত্র ও সাম্যের আদর্শ তারা কীভাবে উপলব্ধি করছে?

জাতীয় চেতনা ও ঐক্যের প্রতীক: ২৬শে মার্চ জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের সংগ্রামী অতীতের কথা। এ দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশের মানুষের মধ্যে যে ঐক্যবদ্ধ আবেগ সৃষ্টি হয়, তা আজও জাতীয় জীবনে সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। জাতীয় পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইতিহাস স্মরণ, শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন- সবকিছুতেই এক ধরনের জাতীয় চেতনার প্রতিফলন ঘটে। এটি তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে এবং দেশের জন্য নিজেদের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট: স্বাধীনতার চেতনা বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবেও প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের কর্মসূচি প্রণয়ন করে। ২৬শে মার্চের আদর্শ ও মূল্যবোধ- গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, শোষণমুক্ত সমাজ- এখনও দেশের নীতিনির্ধারকদের দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও এ দিনটিকে কেন্দ্র করে নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে, যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি হয়।

উন্নয়ন চিন্তাধারায় প্রতিফলন: স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল একটি শোষণমুক্ত, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণসহ নানা ক্ষেত্রে উন্নয়নের চিত্র এ চেতনারই বাস্তব প্রতিফলন। ২৬শে মার্চ প্রতি বছর আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিই প্রকৃত অর্থে শহিদদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ২৬শে মার্চ: আজকের বিশ্বেও ২৬শে মার্চের গুরুত্ব কম নয়। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ইতিহাস সুপরিচিত। এ দিনটি জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের মর্যাদা ও অবস্থানকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যা আমাদের কূটনৈতিক অগ্রযাত্রাতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ চেতনার উপস্থিতি: বর্তমান প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব পৌঁছে দিতে রাষ্ট্র পর্যায়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক ১ম শ্রেণি থেকে ১২শ’ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভূমিকা ও ২৬শে মার্চের তাৎপর্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রতিবার প্রভাতফেরি, চিত্রাঙ্কন, রচনা প্রতিযোগিতা, আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের মনে এই দিবসের তাৎপর্য ঢুকিয়ে দিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, তবে শিক্ষকের আন্তরিকতা ও পরিবার থেকেও বাস্তব জীবনের গল্প শোনানো প্রয়োজন।

সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ২৬শে মার্চ: বর্তমান প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর। প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে একটি জরিপে দেখা যায়, তরুণদের ৬৭ শতাংশ স্বাধীনতা দিবসের তথ্য মূলত সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই গ্রহণ করে। তবে এখানে সমস্যা হলো- সত্যিকারের ইতিহাসের চেয়ে অনেক সময় ভ্রান্ত তথ্য বা অতিরঞ্জিত উপস্থাপনা বিভ্রান্তি তৈরি করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোকে আরও ইতিহাসনির্ভর, নির্ভুল কনটেন্ট তৈরি করতে হবে তরুণদের।

সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বর্তমান প্রজন্মের সম্পৃক্ততা: বাংলা সাহিত্য, নাটক, সিনেমায় ২৬শে মার্চ ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনার ছাপ স্পষ্ট। হুমায়ূন আহমেদ, সেলিনা হোসেন, শহীদুল জহিরসহ বহু লেখকের রচনায় স্বাধীনতার গল্প ফুটে উঠেছে।

তবে সাম্প্রতিককালের সমীক্ষা বলছে- ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সি তরুণদের ৪৫ শতাংশ নিয়মিত সাহিত্যপাঠ করে না। ফলে তারা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে আগের মতো সংযুক্ত নয়। তবে আশার কথা, নতুন কিছু তরুণ নির্মাতা ও সাহিত্যিক মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

উদাহরণস্বরূপ, ‘দামাল’, ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’, ‘গেরিলা’ সিনেমাগুলো তরুণদের মাঝে আলোচনার সৃষ্টি করেছে। জাতীয় দিবস পালনে আনুষ্ঠানিকতা বনাম অন্তর্নিহিত চেতনা প্রতিবছর দেশের সর্বত্র ২৬শে মার্চ উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান হয়। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শোভাযাত্রা, স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক তরুণের কাছে এ দিবস কেবল ছুটির দিন বা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স (BBS)-এর এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২৬শে মার্চে অংশগ্রহণকারী তরুণদের ৩৫ শতাংশ মনে করে তারা দিবসের প্রকৃত ইতিহাস পুরোপুরি জানে না। সমাজ বিনির্মাণে তরুণদের ভূমিকায় স্বাধীনতার চেতনার প্রতিফলন।

তবে একইসঙ্গে উৎসাহব্যঞ্জক চিত্রও রয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের বড় একটি অংশ সামাজিক উদ্যোগ, উদ্যোক্তা কার্যক্রম, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, মানবিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করছে। তারা মনে করে- একটি শোষণমুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখাই ২৬শে মার্চের চেতনার বাস্তবায়ন।

পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান প্রজন্মের একাংশ ইতিহাস, সাহিত্য, গণমাধ্যম ও নিজের সচেতনতায় ২৬শে মার্চের চেতনা লালন করছে। অন্যদের মধ্যে এই চেতনা জাগ্রত করতে হবে সামষ্টিকভাবে। এখানে শুধু সরকার নয়, দলগতভাবে সব শ্রেণির মানুষের পাশাপাশি পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে যেন ইতিহাস বিকৃত না হয়। আগামী প্রজন্মের সামনে সঠিক সত্য ইতিহাস তুলে ধরে স্বাধীনতার মান রক্ষা করতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত