ঈদযাত্রায় সড়কে বেপরোয়া হয়ে ওঠে যানবাহন। বাসের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে সড়কে ছুটে চলে মোটরসাইকেল। ঈদে প্রতিবারই রোডক্র্যাশের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। গত ঈদেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ- বিআরটিএ’র তথ্যমতে গত পবিত্র ঈদুল ফিতরের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের রোডক্র্যাশে ১৭ দিনে সারা দেশে ২৮৬টি রোডক্র্যাশ ঘটে। এতে ৩২০ জনের মৃত্যু এবং ৪৬২ জন আহত হয়। আর গত ঈদুল আজহার আগে ও পরে ঈদযাত্রায় ১২ দিনে ২১৬টি রোডক্র্যাশ ঘটে। এতে ২১৫ জন নিহত ও ২৭৮ জন হয়। ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে রোডক্র্যাশে ১৫ দিনে ২৩৯ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালে ঈদে যেখানে ঈদুল ফিতরে রোডক্র্যাশে দিনে ১৬ জন করে মারা গেছেন। সেখানে ২০২৪ সালে দিনে ১৯ জন করে মারা গেছেন। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি নিহত হয় বলে জানায় বিআরটিএ। বিআরটিএ বলছে, গত ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি রোডক্র্যাশের শিকার হয় মোটরসাইকেল ১১৭টি, যার হার প্রায় ২৯ শতাংশ। তারপর ৭৭টি বাস বা মিনিবাস, ৫৩টি কাভার্ডভ্যান, ২৯টি অটোরিকশা, ১৯টি পিকআপ, ১৮টি জিপ বা মোটরকার, ১৬টি ইজিবাইক, ১৬টি ব্যাটারিচালিত রিকশা, ১১টি মাইক্রোবাস, ৮টি ভ্যান এবং অন্যান্য ৩৯টি যানবাহন রোডক্র্যাশের শিকার হয়। সড়কে বেশিরভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে ফাঁকা রাস্তা পেয়ে উঠতি বয়সি তরুণ এবং যুবকরা ঈদের ছুটিতে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে এই রোডক্র্যাশ ঘটে। ঈদের ছুটিতে মোটরসাইকেলে ঘোরাঘুরির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে যায়। ঈদকে সামনে রেখে মহাসড়কে যানবাহনের অপ্রত্যাশিত গতি রোডক্র্যাশের অন্যতম কারণ। সড়কে গতিবিধি মেনে গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করতে পারলে রোডক্র্যাশ অনেকাংশেই রোধ করা যাবে। গতিবিধি না মেনে গাড়ি চালালে তার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের একটু অসাবধানতা কেড়ে নিতে পারে অসংখ্য মানুষের প্রাণ। রোডক্র্যাশে যারা মারা যান তারা একেবারেই চলে যান, যারা আহত হন তারা হয়তো পরবর্তীকালে সুস্থ হন। কিন্তু যাদের অঙ্গহানি ঘটছে তাদের বাকি জীবনে আর সুস্থ হওয়ার বা হারানো অঙ্গ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাদের জীবনটা নির্মম হয়ে পড়ে। সড়কে মৃত্যু প্রতিরোধে প্রয়োজন একটি ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’। গত বছরে ৫ হাজার ৮৫৬টি রোডক্র্যাশে ৫ হাজার ৪৮০ জন নিহত ও ৬ হাজার ৪৬২ জন আহত হয়। আর চলতি বছরের গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৮৬৪ টি রোডক্র্যাশে ৮৪৪ জন নিহত ও ১ হাজার ২২৭ জন আহত হয়েছে। রোডক্র্যাশ প্রতিরোধে প্রথমে প্রয়োজন একটি উপযুক্ত আইন, যা বাংলাদেশে নেই। তাই একটি সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন অতিব জরুরি। এবং এর যথাযথ প্রয়োগ ও আইন প্রতিপালনে জনসচেতনতাই পারে রোডক্র্যাশ প্রতিরোধ করতে। বাংলাদেশে দেখা যায় বেশিরভাগ রোডক্র্যাশ সংঘটিত হয় গতির কারণে। তাই দেশের সড়ক পরিস্থিতির কথা ভেবে নিরাপদ গতি নির্ধারণ করা উচিত। সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২-এ সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ওই বিধিমালায় গাড়ির গতিসীমা, সিটবেল্ট, মানসম্মত হেলমেট, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো এবং শিশু আসন ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেয়া হয়নি। বেপরোয়া গতি, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ও যাত্রী ওঠানামা করা, সাইকেল-রিকশা-মোটরগাড়ি একই সঙ্গে চলাচল করার ফলে রোডক্র্যাশ নেমে আসছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গতিসীমা নির্ধারণ করে দেয়া থাকলেও চালকরা তোয়াক্কা করছেন না। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে প্রতিবছর ঈদ পূর্ব যাতায়াতকালে রোডক্র্যাশে মানুষ মারা যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে বছরে ৩১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় দুর্ঘটনায়; আহত হন ৩ লাখের বেশি। এই প্রতিরোধযোগ্য রোডক্র্যাশ প্রতিরোধে দরকার সড়ক নিরাপত্তা আইন। ঈদের সময় আমাদের দেশের সড়কগুলো যেন হয়ে ওঠে এক একটি মৃত্যুফাঁদ। প্রতিনিয়ত রোডক্র্যাশের খবর পাওয়া যায়। কর্মব্যস্ত নগরী থেকে কিছুদিনের জন্য হলেও প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটাতে চিরচেনা সেই নিজ বাড়িতে ছুটে যায় সব স্তরের মানুষ। মূলত নাড়ির টানে ঘরে ফেরা মানুষের আসল যুদ্ধ শুরু হয় পবিত্র ঈদ এলেই। উৎসবকে কেন্দ্র করে বেড়ে যায় রোডক্র্যাশের মাত্রা। ঈদে নিরাপদে বাড়ি ফেরার প্রত্যাশা থাকে সবার। এই আনন্দকে আরও পূর্ণতা দিতে ও রোডক্র্যাশরোধ করতে শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে হবে। তবে একই সঙ্গে জনগণকেও হতে হবে সচেতন।
ঈদুল ফিতর উদযাপন উপলক্ষে সড়কপথে যাত্রীসাধারণের যাতায়াত নির্বিঘ্নে ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে এবং আনন্দযাত্রায় রোডক্র্যাশে শত শত মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে যেসব পদক্ষেপ দ্রুত নেয়া দরকার তা হলো: অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণ করা, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে স্পিডগান ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, মোটরসাইকে চালক-আরোহীর মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি না চালানো, মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক, প্যাডেলচালিত রিকশা, অটোরিকশা, নছিমন-করিমন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু সরকারের একার পক্ষে কোনো কিছুই মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে আমাদের এসব দুর্ঘটনা রোধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা উচিত।
৯০ শতাংশ রোডক্র্যাশের জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব। গতিবিধি না মেনে গাড়ি চালালে তার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা প্রয়োগ করতে হবে। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। রোডক্র্যাশরোধে আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। তাই অতিদ্রুত একটি ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ এখন সময়ের দাবি।
ঈদের খুশি ভাগাভাগি করতে পথে যেন কারো জীবন চলে না যায়, পরিবার-স্বজনদের সাথে সুস্থভাবে দেখা মিলুক সবার। আনন্দের ঈদযাত্রা যেন বিষাদে পরিণত না হয়, এই প্রত্যাশা সবার। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সমাজের সব স্তরের মানুষের মাঝে, ঈদে বাড়ি ফেরার যাত্রা হোক নিরাপদে। শুভ হোক সবার ঈদযাত্রা।