দল-মত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনে হাজার হাজার আহত নিহতের রক্তে জুলাই বিপ্লবের বিজয় এসেছে ছাত্র সমন্বয়কদের নেতৃত্বে তাতে কোনো বিতর্ক নেই। দেশের মানুষের বিশাল প্রত্যাশা ছিল একটা পরিবর্তন একটা সংস্কার। কিন্তু অবস্থা লক্ষণে তা ম্লান হতে বসেছে। রাজনীতি করাই দেশ পরিচালনা করবে- এটাই নিয়ম।
কিন্তু রাজজনীতি এখন আর খুব একটা ভালো জিনিস না। কোথায় যেন পড়েছিলাম আগে রাজনীতি করতে গিয়ে ধনী-গরিব হয়ে যেত আর এখন গরিব রাজনীতি করে রাতারাতি ধনী হয়ে যায়। আগে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মাটি ও মানুষের সম্পর্ক ছিল এখন শুধুই সম্পর্ক নির্বাচনে ভোটের সাথে। হাজার হাজার আহত-নিহত ছাত্র-জনতা কথা ভুলে সবাই এখন কেবল নির্বাচন নিয়ে মেতে আছে।
একদল অতি দ্রুত নির্বাচন চাইছেন আবার আর একদল যারা এখনো নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারেননি, তারা সময় চাইছেন। যেমনটি স্বৈরচারের স্লোগান ছিল আগে উন্নয়ন পরে নির্বাচন এখন তাদের স্লোগান আগে সংস্কার পরে নির্বাচন।
সাত মাস অতিক্রান্ত প্রায় প্রধান উপদেষ্টার কথা মতো নির্বাচন অতি সন্নিকটে কিন্তু সংস্কার দৃশ্যমান হয়নি। বিপ্লবের বিজয়ের পর নতুন প্রজন্মের সমন্বয়করা অতি প্রয়োজনীয় এবং করণীয় কার্য না করে, রাজনীতির পাঠ না নিয়ে অতি দ্রুত রাজনৈতিক দল গঠন করে রাজনীতির প্রথম পদক্ষেপ সম্ভতঃ ভুল করে ফেলেছেন। সমন্বয়কদের নতুন ‘জাতীয় নাগরিক পাটি’ গঠন বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে শোভা যাত্রা, বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন, হেলিকপ্টারে ভ্রমণ ওয়াসা নিয়োগ বাণিজ্যে সংশ্লিষ্টতার খবরে অবধারিত দেশের একটা পরিবর্তন জাতির সেই আকাঙ্ক্ষায় কোথায় যেন একটা আশঙ্কা তৈরি হয়ে গেছে।
সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিবেদিত আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধানের অনানুষ্ঠানিক কথোপকথন নিয়ে সমন্বয়ক হাসনাতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টকে কেন্দ্র করে পুরো সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি করার জন্য কারো কারো অতি বিতর্কিত অতি আবেগি শব্দের ব্যবহার করার আগে চৌদ্দবার ভাবা উচিত।
এই সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকায় আগস্ট বিপ্লবে লাখো লাশ রাস্তায় পড়েনি। এই সেনাবাহিনী থাকায় পুলিশ প্রশাসন বিহীন দেশে অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে পারেনি, এই সেনাবাহিনী থাকায় আগস্ট থেকে চলমান দেশি-বিদেশি চক্রান্ত এখনো সফল হতে পারেনি। যারা সেনাবাহিনী, সেনানিবাস নিয়ে গলাবাজী করছেন, সেনানিবাস উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছেন তাদের গলাবাজীর লাগাম টানতে হবে। দীর্ঘদিন খোয়ারে আবদ্ধ অভুক্ত গরু-ছাগল ছাড়া পেয়ে যেভাবে সামনে যা পায়, তা খেতে শুরু করে তেমনি, আগস্ট বিপ্লবের পর দ্বিতীয় স্বাধীনতার নামে যা- তা বলবেন আর জাতি তা মেনে নেবে ভাবলে ভুল হবে। সেনাবাহিনী, সেনানিবাস দেশপ্রেমিক জনগণের শেষ আস্থার স্থল। সুতরাং সাবধান দেশপ্রেমিক জনগণ আপনাদের প্রতিরোধে রাস্তায় নামতে পারে আর নামলে পালাবার পথ খুজে পাওয়া মুশকিল হবে।
শুরুতেই বিপ্লবের নায়ক সমন্বয়কদের রাজনীতি এবং ক্ষমতায় দ্রুত জড়িয়ে দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ভুল করা হয়েছে। যে দলগুলো হাজার হাজার নেতাকমী’ দীর্ঘ দেড় দশক গুম-খুন হামলা-মামলায় পরিবার ঘরছাড়া হয়ে অনাহারে নিদ্রাহীন মানবেতর দিন কাটিয়েছে। উচিত ছিল তাদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়া। রাজনৈতিক দল গঠনে নজর না দিয়ে প্রথমেই আহত নিহত পরিবারদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন দেখ ভালের ব্যবস্থা করা, অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থায় ইনটেরিম সরকারকে সহযোগিতা করা। কোথাও অনিয়ম দেখলে প্রশাসনের নজরে আনা, একটা প্রেশার গ্রুপ হিসাবে ইনটেরিম সরকারের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করা। তা হয়নি।
দল গঠন নিয়ে সময় পেরিয়ে গেছে। দল গঠন করে পদপদবি নানা লোভে নিজেরাই এখন নানা ভাবে বিভক্ত। শোনা যায় সমন্বয়কদের কেউ কেউ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের কারো কারো আত্মীয়দেরও নাম আসছে। একদিকে যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ডাক দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে প্রচারণায় গিয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকমী নিয়ে মিছিল সমাবেশ করা হচ্ছে। প্রশ্ন করলে জবাব আসে নিরাপত্তার কারণে ছাত্রলীগে ছিল। প্রশ্ন কোন নৈতিকতায়? একই কথা কেন অন্যদলের ক্ষেত্রে মানা হবে না। কিছু দিন আগে পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে আগের দিন ঘটে যাওয়া ঘটনায় কিছু ছাত্রদের দাম্ভিক আচার-আচরণে ছাত্রদের প্রতি কর্মচারীদের যে ক্ষোভ দেখেছি তা কখনো এতো দ্রুত হবে ভাবি নাই। দেশে যখন ঐক্যের প্রয়োজন তখন সেনাপ্রধান-সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার মতো স্পর্শকাতর বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনা ঠিক হয় নাই। উপদেষ্টা পরিষদে একাধিক ছাত্র প্রতিনিধি রয়েছে, সেখানে বিষয়টি আলোচনা হতে পারতো। যদিও সারজিশ এর ব্যাখা পাওয়া গেছে; কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। একই আলোচনার উপস্থিত দু’জনার দু’রক্ম উপস্থাপন কেন? নানাভাবেই এমন বিভাজন চাইছে ষড়যন্ত্রকারীরা আমরা সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি।
জাতীর আস্থা ভরসারস্থল সেনাবাহিনীর আলোচনা এখানেই শেষ হওক। আওয়ামী লীগের থাকা না থাকা আইনি প্রক্রিয়া। পিলখানায় সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ডে বিডিআর এর নাম পোশাক পরিবর্তন হতে পারলে জাতিসংঘ স্বীকৃত হাজার হাজার ছাত্র-জনতা হত্যকারী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হতে বাধা হবার কথা নয়। তবে জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে যথাযথ আইনের প্রক্রিয়ায় তা সম্পন্ন করতে হবে। যেন আগামীতে কোনো একক দলের ইচ্ছায় কোনোভাবেই যখন তখন পরিবর্তন সহজ না হয়।
সন্দেহ নাই এমন ব্যবস্থা থাকলে আগামীতে কোনো রাজনৈতিক দল কখনো স্বৈরাচারী হয়ে দেশের বিরুদ্ধে ও দেশের জনগণের ওপর নৃশংসতা চালাতে ভাবতে হবে। যে কোনো দল, যে কোনো সময় অবাঞ্চিত হতে পারে নেতানেত্রীদের জন্য ভয়ের কারণ হবে। জনগণের দাবি থাকবে প্রত্যাশা থাকবে। কিন্তু ইনটেরিম সরকার আছেন দেখভাল করার দায়িত্ব শুধু তাদেরই উপরেই দেয়া হোক। সকলকে ধৈর্যশীল সহনশীল হতে হবে এবং একে অপরকে সম্মান দিতে হবে।
বিপ্লবের সাত মাস পর বহুধাবিভক্ত ছাত্রশক্তির এককভাবে কিছু করা সম্ভব নয়, অতি আবেগি হওয়ারও সুযোগ আর নাই। তাতে দেশ অস্থিতিশীল হবে ঘরে বাইরে ষড়যন্ত্রকারীরা শক্তিশালী হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হবার আশঙ্কা থাকবে। সেনাবাহিনীকেও রাজনীতি থেকে দূরে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। যদিও বারবার আমাদের রাজনীতিকরা দেশকে অস্থিতিশীল করেছেন, দেশ ও জাতিকে সংকটে ফেলেছেন আর সেই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সেনাবাহিনীকেই জনগণের জানমাল নিরাপত্তায় এগিয়ে আসতে হয়েছে। এখন ব্লেমণ্ডগেম খেলার সময় নয়।
দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় ফিরে আসে নাই, লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার হয় নাই, জেলপলাতক আসামি ধরা পড়ে নাই, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মাঝে মারামারিতে হতাহত বাড়ছে, বহিষ্কার করেও সামাল দেয়া যাচ্ছে না, আসনভিত্তিক নমিনেশন দেয়ার সময় দলীয় কোন্দল ব্যাপকহারে বাড়তে পাড়ে। প্রশাসনের চারিদিকে স্থবিরতা কাটে নাই। দল-মত নির্বিশেষে সকলের ঐক্যের প্রয়োজন এবং সেই ঐক্যের মাধ্যমে উপদেষ্টা ড: ইউনূসের হাতকে শক্তিশালী করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের কাছে ক্ষমতা হস্থান্তর করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার চিন্তা করতে হবে। দেশ অস্থিতিশীল করার যে কোনো অপচেষ্টা রুখতে একতাবদ্ধ থাকতে হবে। রাজনীতিবিদদের এখনো সময় আছে ভাবতে হবে চারিদিকে বিদ্যমান পতিত সরকারের দলদাস দলকানা বিপুল সমথর্ক, দেশের ভেতরে-বাইরে ষড়যন্ত্র নিয়ে পারবেন ক্ষমতায় গিয়ে দেশ চালাতে?
নাকি চাইবেন ড: ইউনূস-এর সরকারকে সময় দিয়ে আগাপাছা সংস্কার করে নির্বাচন করতে? প্রয়োজনে উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করুণ পরামর্শ দিন, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করে প্রতিহিংসার যুদ্ধ নয় সৌহার্দ্দপুণ্য নির্বাচন প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করুন। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই শুধু নির্বাচন নয়, একটা সংস্কার একটা পরিবর্তনের সুযোগ এসেছে, সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে, হেলাফেলায় তা নষ্ট করা কোনোভাবে ঠিক হবে না।