ঢাকা বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১৯ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈদে ঘুরছে অর্থনীতির চাকা

অলোক আচার্য
ঈদে ঘুরছে অর্থনীতির চাকা

উৎসবের দেশ বাংলাদেশ। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রতিটি আলাদা আলাদ ধর্মের আলাদা আলাদা উৎসব রয়েছে। আবার রয়েছে বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষ। সেখানেও চাঙ্গা হয়ে ওঠে অর্থনীতি। সেসব উৎসব ঘিরে চলে নানা আয়োজন। মানুষের জীবন-জীবিকায়ও আসে পরিবর্তন। অর্থনীতিতে আসে গতি। বিশেষত মুসলমানদের দুটি ঈদ আর হিন্দুদের দুর্গা পূজা ঘিরে অর্থনীতি বেগবান হয়ে ওঠে। প্রথমত মুসলমানদের পবিত্র দুটো ঈদ অর্থনীতির পালে একটু বেশিই গতি আনে। কারণ ছোট-বড়, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ এবং শিশুরা এ আনন্দে অংশগ্রহণ করে। যেহেতু অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই মুসলমান ফলে বেশিরভাগ মানুষের জীবনেও পরিবর্তন আসে। এ আনন্দ উৎসবের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ হলো ঈদের কেনাকাটা। এ উৎসবের সাথে তাই অর্থনীতির রয়েছে ব্যাপক সম্পর্ক। কারণ উৎসব মানেই বাজার এবং বাজারের গতি মানেই অর্থনীতি বেগবান হওয়া। যে খাতগুলোতে ঈদ উপলক্ষে গতির সঞ্চার হয় সেগুলো হলো, পোশাক, গহনার বাজার, চামড়ার তৈরি পণ্য মানে চামড়ার বাজার, ইলেক্ট্রনিক্স শিল্প, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বোনাস, বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বোনাস, খাদ্য ও ভোগ্য পণ্যের বাজার ইত্যাদি। এর বাইরেও বহু খাতে গতি আসে ঈদ উপলক্ষে। ঈদ উৎসবকে ঘিরে অর্থনীতিতে যুক্ত হয় নতুন অতিরিক্ত চাহিদা। আর অতিরিক্ত এ চাহিদার যোগান দিতে প্রয়োজন হয় বাড়তি সরবরাহের। বাড়তি সরবরাহের জন্য প্রয়োজন বাড়তি উৎপাদন। আর অতিরিক্ত উৎপাদন আসে বাড়তি কর্মসংস্থান থেকে। ফলে যোগানদাতা এবং যিনি যোগান নেন মানে ক্রেতা সবাই অর্থনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এভাবে ঈদ আসলেই প্রতি বছর দেশের অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি পায়। ঈদের পরেই আসবে বাংলা নববর্ষ। সেই প্রস্তুতিও চলছে। ঘরে ঘরে নতুন পোশাক নেয়ার ধুম পরে যায়। আর সেই লক্ষ্যে ব্যবসায়ীরা দোকানে দোকানে নতুন ফ্যাশনের পোশাক ঘরে তোলে। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নবিত্তও এই কেনাবেচায় অংশ নেয়। ২০১৬ সাল থেকে বৈশাখি ভাতা চালু করেছে। দেশের চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ২০ ভাগ বৈশাখি ভাতা পেয়ে থাকেন। ঈদের বোনাসের সাথে পহেলা বৈশাখের ভাতা এই দুইয়ে কেনাকাটা আরও গতি লাভ করেছে।

ঈদের বাজার মূলত ৮০ শতাংশ পোশাককেন্দ্রিক। বাকি ২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় অন্যান্য পণ্যে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০২৪ সালে) এক লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যবসা হয়। তার আগের বছর ২০২৩ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা হয় এক লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। ১০ বছর আগে ২০১৫ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো। এবার ঈদকেন্দ্রিক আড়াই লাখ কোটি টাকার কম ব্যবসা হতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। ঈদের বাজার মূলত ৮০ শতাংশ পোশাককেন্দ্রিক। বাকি ২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় অন্যান্য পণ্যে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০২৪ সালে) এক লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যবসা হয়। তার আগের বছর ২০২৩ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা হয় এক লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। ১০ বছর আগে ২০১৫ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো। এবার ঈদকেন্দ্রিক আড়াই লাখ কোটি টাকার কম ব্যবসা হতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। ঈদের আগে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে; যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি বাড়িয়েছে। জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথম ২৬ দিনে ২৯৪ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। এর মধ্যে শেষ দুই দিনে এসেছে ১৯ কোটি ৭০ লাখ ডলারের আয়। প্রবাসী আয়ের ধারা বিবেচনা করলে বলা যায়, চলতি মাসে নতুন রেকর্ড করতে যাচ্ছে প্রবাসী আয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাকরিজীবীদের বেতন-বোনাস ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও টাকার লেনদেন বৃদ্ধি পাবে।

কিছু বেসরকারি সংস্থা তাদের কর্মজীবীদের এ ভাতা প্রদান করে থাকে। প্রাপ্ত এ ভাতার সর্ব নিম্ন পরিমাণ ২ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ ১৬ হাজার টাকা। যদিও অধিকাংশ বেসরকারি চাকরিজীবীই বৈশাখি ভাতা পান না, তবুও সবাই প্রস্তুতি নেন পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পরিবার পরিজনকে নতুন পোশাক কিনে দেয়ার। আবার বাংলা নতুন মাস থেকেই শুরু হবে দোকানে দোকানে হালখাত। হালখাতায় ব্যবসায়ীরা তাদের বকেয়া পাওনা আদায় করবেন। এসব একসঙ্গে যোগ হয়ে দেশের অর্থনীতির পালে হাওয়া যোগাবে। যদিও দেশের অর্থনীতি এই সময় একটু চাপে রয়েছে এবং রিজার্ভও মাঝে মধ্যেই ওঠানামা করছে। পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত ঈদে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের এক বিশাল বাজার। ঈদের অর্থনীতিতে পোশাক, জুতা, ভোগ্যপণ্য ও ইলেক্ট্রনিক্সের মতো শীর্ষ ১০ পণ্যের কেনাকাটায় বাণিজ্য হয় দেড় লাখ কোটি টাকার ওপরে। এর বাইরে আরও অনেক রকম পণ্যের কেনাকাটা ও লেনদেন হয় প্রায় আরও ৫০ হাজার কোটি টাকা। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরও প্রায় দেড় কোটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বোনাস। এ পরিমাণ টাকার সবই ঈদ অর্থনীতিতে যুক্ত হয়। বছরের শুরু থেকেই মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার কারণে এবার ব্যবসায়ীরা গতবারের চেয়ে বাণিজ্য আরও বেশি হতে পারে বলে আশা করছেন। ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা, এবারের ঈদবাজারে আড়াই লাখ থেকে পৌনে তিন কোটি টাকার বাণিজ্য হতে পারে। এর মধ্যে শুধু পোশাকের বাজারেই লেনদেন হতে পারে ৮০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া নিত্যপণ্যের বাজারে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এর বাইরে ইলেক্ট্রনিকস সামগ্রী, মিষ্টির বাজার, বিনোদন ও পরিবহন খাতে বাড়তি অর্থ যোগ হবে। পাশাপাশি সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঈদ বোনাস, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় কোটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঈদ বোনাস এবং দোকান কর্মচারী, পোশাক ও বস্ত্র খাতের শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবীদের ঈদ বোনাসও যুক্ত হবে ঈদবাজারে।

২৫ লাখ বা তার কিছু বেশি দোকান, শপিংমল ও বাণিজ্য বিতান রয়েছে। গড়ে একটি দোকানে ৩ জন করে প্রায় ৬৫ লাখ জনবল কাজ করছে। সংগঠনটির হিসাবে নিম্নে একজন কর্মীকে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাস দেয়া হয়। ওই হিসাবে গড়ে বোনাস ৮ হাজার টাকা ধরে ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বোনাস দেয়া হয়। অর্থাৎ একটি বিপুল পরিমাণ অর্থ আমাদের অর্থনীতিতে যোগ হয়। ঈদের পরপরই রয়েছে পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ মানেই গ্রামীণ সংস্কৃতির বিকাশ। বৈশাখি অর্থনীতির বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রামীণ মেলা ও গ্রামীণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পণ্য যত বেশি বিক্রি হবে, ততই গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হলেই তা জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখতে পারবে। গ্রামীণ মৃৎশিল্প, নকশিকাঁথা, গ্রামীণ মিষ্টি ইত্যাদি ব্যবসায় গতি আসে। মানুষের পকেটে আসে স্বস্তির বাতাস। অর্থনীতিতেও আসে শান্তি। আমাদের অর্থনীতির প্রধান শক্তি হলো প্রবাসী আয় থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স। যদিও রেমিট্যান্স আদায়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, যা সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। জানুয়ারির প্রবাসী আয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়েছে, যা তখন ছিল ১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। জানুয়ারির আয়সহ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে প্রবাসী আয় ৩ শতাংশ বেড়ে ১২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এসবের বাইরে আরও বহু উৎসব রয়েছে এই বাংলাদেশে। ঈদুল ফিতরের পর আসে ঈদুল আজহা। সেই উৎসবেও বেতনের বাইরে কর্মকর্তা কর্মচারীদের বোনাস এবং একই রকম কেনাকাটা চলে। আরও বাইরে হিন্দু ধর্মের দুর্গা পূজা এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বিদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও বাজার জমে ওঠে। প্রতিটি উৎসবেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে আমাদের অর্থনীতি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত