দেশে প্রতিবছরই বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হয়। দিনব্যাপী সেমিনার সিম্পোজিয়ামে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের কথা আলোচনা হয়। আশা করি আগামী ২রা এপ্রিল আবারও যথাযথ দিবসটি পালিত হবে। কিছুদিন আগে সাংবাদিক তারিক চয়নের ফেস বুক ওয়ালে একটা পোস্ট দেখলাম এক মায়ের আকুতি: ‘আমি মনে প্রাণে চাই, আমার অটিষ্টিক মেয়েটা খুব শিগগিরই মরে যাক আর সহ্য করতে পারি না’। কতটা বেদনা কতটা হতাশায় নিমজ্জিত হলে জন্মদাত্রী তার সন্তানের মৃত্যু কামনা করতে পারেন? অটিজম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা সহজ এবং পিতা-মাতার সামর্থ্যরে মধ্যে রাখায় সরকার এবং দেশের সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার বিষয়ে লিখতে গিয়ে অনেক আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর হাতে তখন অফুরন্ত সময় । শুয়ে বসে ইন্টারনেট ঘেটে তা যেন কাটতে চাইত না। তাই ছোট ভাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘গিফট গার্ডেন’-এ গিয়ে বসতাম। তাতে করে ছোট ভাইকে কিছুটা সাহায্য করা সেইসঙ্গে নিজের কর্মহীন অফুরন্ত সময় কাটত। এমনি এক সন্ধ্যায় দূর থেকে একটা করুণ আকুতি কেবলই নিকটবর্তী হচ্ছিল। মনটা আগে থেকেই ভালো যাচ্ছিল না। করুণ আকুতি বুকের ভেতর কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। গ্লাস ডোর ঠেলে বাহিরে এসে দাঁড়ালাম। আকুতির উৎস খুঁজতে চেষ্টা করে প্রথমে ব্যর্থ হলাম। এদিকে ওদিকে তাকাতে দূরে মানুষের আনাগোনা লক্ষ্য করে দেখলাম কিছু একটা গড়িয়ে আসছে আর সেখান থেকেই এই আকুতি। কাছে আসতে দেখা গেল একটা বিশ-পঁচিশ বছরের যুবক হাত পা সবই পঙ্গু। পিঠ এবং কোনো রকমে পা দিয়ে সম্মুখে যাওয়া আর মুখ দিয়ে করুণ আকুতিতে ভিক্ষা চাওয়া, পুরাটা স্পষ্ট নয়। মানুষ এবং মানবতার জন্য এ দৃশ্য বড়ই পীড়াদায়ক। যে কোনো মানুষের হৃদয়ের গভীরে তা ব্যথা লাগারই কথা। পুনর্বাসন যদি করতেই হয় প্রথমে এসকল পঙ্গু বিকলাঙ্গ অসহায়দের পুনর্বাসন বড় বেশি প্রয়োজন। এরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তাদের ভরণ-পোষণ দিতে হবে, তাদের থেকে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতীর কিছুই আশা করার নেই। শুধু এই ভিখিরির কথা নয়। রাস্তা-ঘাটে ওভারব্রিজ ফুটপাতে এরকম অসংখ্য বিকলাঙ্গ মানুষকে অমানবিকভাবে ফেলে রেখে দূরে সতেজ সুস্থ সবল মানুষকে পথচারী মানুষের দুর্বল মনে আঘাত করে অর্থ উপার্জন করতে দেখা যায়। সেই সমস্ত বিকলাঙ্গ মানুষের অবস্থা দেখে রাস্তায় চলাচলকারী আমাদের কোমলমতি শিশুদের মনের উপর একটা প্রভাব পড়ে। অনেকবারই খবর বেরিয়েছে এক শ্রেণির মানুষরূপী অমানুষরা শিশুদের হাত পা ভেঙে বিকলাঙ্গ করে বড় করে তোলে। পরে ভিক্ষা বৃত্তিতে নামিয়ে মানুষের দুর্বল মনে আঘাত করে অর্থ উপার্জন করে। যদি তাদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয় একসময় অমানুষদের, শিশুদের বিকলাঙ্গ করার প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে। দেশে এমন প্রতিবন্ধী মানুষ ছাড়াও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাদের অনেক ধরনের সমস্যা আছে। কারো আছে শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা, কারো কথা বলা ও শোনার সমস্যা, কারো সবকিছুতেই অমনেযোগী, কেহ খুব বেশি চঞ্চল, কারো আবার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বেকে যাওয়া, বয়স অনুযায়ী মানসিক বিকাশ না হওয়া ছাড়াও নানা সমস্যা। গুগল থেকে ‘ইপন’এর একটা অনেক আগের গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়- শহরে প্রতি দশ হাজারে সতের শিশু অটিজমে আক্রান্ত। গ্রামে এর সংখ্যা নাকি আরও বেশি। এদের কারো দরকার বিহেবিয়ার থেরাপি, কারো প্রয়োজন স্পিচ থেরাপি, কারো অকুপেশনাল থেরাপি, কারো দরকার ফিজিও থেরাপি। জন্মগত সমস্যা তো আছেই ডিজিটাল যুগে এসে শিশুদের ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইজে আসক্ত করে পিতা-মাতার অসচেতনতা, অবহেলা, অজ্ঞতায় সুস্থ শিশু নিজেদের অজান্তেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। একবার এমনি এক যুবতী মায়ের সাথে আলাপ হয়, তিনি জানান বাচ্চার দুই বছর পর মাস্টারস পরীক্ষা জন্য তৈরি হতে গিয়ে ছেলেকে শান্ত রাখতে হাতে ডিভাইস তুলে দিয়ে ছেলের সর্বনাশ করে ফেলেছেন। ছেলে আর মোবাইল ছাড়া শান্ত থাকে না। এভাবে বছর পার হয় কিন্তু পড়াশুনায় কিছুতে আনা যায় না। কারো সঙ্গে কথা বলে না। কারো সঙ্গে মেশে না। এখন স্কুলে দিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বিভিন্নজন বিভিন্ন প্রশ্ন করলে নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হয়। সবাই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে হাসি-খুশীতে থাকলেও নিজে তা পারছেন না। এছাড়াও সামাজিক কুসুংস্কারের ফলে সন্তানের পিতা-মাতা হীনম্মন্যতায় ভোগে সন্তানকে কারো সামনে নিয়ে যেতে সংকোচবোধ করে। সন্তানকে কারো সাথে মিশতে দেয় না, খেলাধুলা করতে দেয় না। ফলে যে সমস্যা দশটা ছেলে-মেয়ের সাথে মিশলে খেলাধুলা করলে ভালো হতে পারত তা আর হয়ে ওঠে না। এক সময় বয়স বাড়ে দৈনন্দিন জীবনযাপনের কিছু জানার এবং শেখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ স্কুলেও ভর্তি করা সম্ভব হয় না। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য সরকার চাকরি, রাস্তায় চলাচলের বিভিন্ন সুবিধা ছাড়াও সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানা যায়। সরকারি পৃষ্টপোশকতায় বেসরকারিভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। কিন্তু মানসম্পন্ন সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা পিতা-মাতার জন্য একেবারেই অসম্ভব তাতে কোনো সন্দেহ নাই। প্রয়োজনেই দু’চারটা প্রতিষ্ঠান দেখার এবং মোবাইলে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেছি মাঝারি মানসম্পন্ন একটা স্কুলে প্রথমেই ভর্তি করাতে বাইশ থেকে পচিশ হাজার টাকা, মাসিক বেতন আট হাজার থেকে তেরো-চৌদ্দ হাজার টাকা এবং থেরাপি (যদি প্রয়োজন হয়) প্রতি থেরাপিতে প্রতিদিন আটশত টাকা অর্থাৎ একটা সন্তানের পেছনে ভর্তি ফি ছাড়া মাসে গড়ে ২০ দিন ক্লাস ধরলে বেতন ৮০০০+ ১৬০০০ (একটা থেরাপি ৮০০/প্রতিদিন) = ২৪,০০০.০০ টাকা প্রয়োজন। শুনেছি একলাখ টাকা ভর্তি এবং চল্লিশ হাজার টাকা মাসিক বেতনেরও স্কুল এই ঢাকা শহরে আছে। এতো টাকা দিয়ে ক’জন মা-বাবা তার সন্তানকে পড়াতে পারবেন? কম সার্ভিস চার্জের প্রতিষ্ঠান যে নেই তা নয় কিন্তু একজন শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে মানসিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অথবা কথা বলা ও শোনার সমস্যা, কিংবা অমনেযোগী, কিংবা খুব বেশি চঞ্চল শিশুদের শিক্ষক স্বল্পতার কারণে একসঙ্গে একই টেবিলে পড়ানো হয়। এটা সঠিক বলে মনে হয় না। শিশুদের মানসিক বিকাশ এবং শারীরিক জড়তা কাটানোর জন্য খেলাধুলা করার প্রয়োজন কিন্তু তার জন্য কোনো জায়গা নেই। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে এমনি চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। আমাদেরই একটা শিশুকে বাসার কাছে উন্নত মানের স্কুলে ভর্তি করতে দুবছর অপেক্ষা করেছি যদি কর্তৃপক্ষ সার্ভিস চার্জ কমায় কিন্তু হয় না। ভর্তি ফি ষাট হাজার সেশন ফি চল্লিশ হাজার এবং মাসিক বেতন পঁচিশ থেকে কমিয়ে তেইশ হাজার টাকা দিতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন অনুমোদিত দুইরুমের একটা ফ্ল্যাট বাসার স্কুলে ভর্তি ফি পাঁচ হাজার এবং মাসিক বেতন এক হাজার টাকায় ভর্তি করাতে হয়েছে। আলাপে জেনেছি এসব শিশুদের সঠিকভাবে পরিচর্যা পরিসেবা দিতে হলে অনেক ক্ষেত্রে শিশুপ্রতি একজন শিক্ষক প্রয়োজন। দেশে পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষকের অভাব আছে। দক্ষ শিক্ষকের বেতন ত্রিশ-চল্লিশ হাজারের বেশি দিতে হয়। তাই শিক্ষকদের বেতন স্কুলের ঘর ভাড়া বেশ ব্যয় সাপেক্ষ যার ব্যয় মেটানোর জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন। তাই বাধ্য হয়েই শিশুদের অভিভাবকদের উপর চাপ বাড়াতে হয়। আমরা দেশকে উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করি বাস্তবে তার কিছুই দেখি না। শুধু দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন যথেষ্ঠ নয়। আমার এক বন্ধুর ভাগিনা এমনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, বিদেশে থাকে।