ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে হবে

আফতাব চৌধুরী
স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে হবে

দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে কম-বেশি অনেকেরই। একেবারে দায়ে না পড়লে কেউ সহজে আজকাল আর সরকারি হাসপাতালমুখো হতে চান না। বিত্তবানদের জন্য সম্প্রতি দেশে গড়ে উঠেছে একাধিক ব্যয়বহুল আন্তর্জাতিকমানের প্রাইভেট হাসপাতাল। সেখানে চিকিৎসা নিয়েও যারা তৃপ্ত নন তারা সহজে পেতে পারেন দেশের বাইরে উন্নততর চিকিৎসাসেবা। কিন্তু, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিত্তহীন বা নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালই একমাত্র ভরসা। তারা সেখানে ভিড় করেন প্রতিনিয়ত, নানা বিড়ম্বনারও শিকার হন। সেখানে নিয়মিত ডাক্তারের উপস্থিতি নেই। রয়েছে ওষুধ-পথ্যের অভাব।

গাঁটের পয়সায় ওষুধপত্র কিনে হাসপাতালে চিকিৎসা লাভের আশায় রোগীদের পড়ে থাকতে হয় তীর্থের কাকের মতো। কখনওবা হাসপাতালে ভিড় করা দালালদের হাতে তাদের হতে হচ্ছে প্রতারিত। সরকারি হাসপাতাল থেকে ডাক্তার কর্তৃক নিয়োজিত দালালরা তাদের ধরে নিয়ে যায় তাদের নিজস্ব প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে। সেখানে গলাকাটা মূল্যের বিনিময়ে অপ্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করিয়ে নানা ধরনের অপচিকিৎসা দিয়ে সর্বস্বান্ত করা হয় দরিদ্র রোগীদের। কখনও অপরিপক্ব বা ভুয়া চিকিৎসকের কবলে পড়ে রোগীকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়। প্রায়ই হাসপাতালে বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সাথে রোগী বা রোগীর আত্মীয়-স্বজনের হাতাহাতি, মারামারি, হাসপাতাল ভাঙচুরের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। কখনও এর সঙ্গে যুক্ত হন অখ্যাত, কুখ্যাত ভুয়া চিকিৎসকরা। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি, আলোচনা-সমালোচনা চলে। প্রতিবাদ, সমাবেশ হয় রাস্তাঘাটে। তবু বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার নামে এমন প্রহসন আজও হ্রাস পায়নি। মানোন্নয়ন হয়নি চিকিৎসা ব্যবস্থার। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোট-বড় সরকারি হাসপাতালের বেশিরভাগ চিকিৎসকই প্রাইভেট ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে অনেক সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক সরকারি চাকুরে চিকিৎসকই আবার প্রাইভেট ক্লিনিকের মালিক বনে যান। অফিসকালীন সময়ে সেখানে বসে তারা নির্দ্বিধায় রোগী দেখেন। রোগীকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে প্যাথোলজিক্যাল টেস্ট করান, গাদাগাদা ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেন। প্রাইভেট প্যাকটিসের প্রতি চিকিৎসকদের সীমাহীন আসক্তির কারণে দেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা একরূপ ভেঙে পড়তে বসেছে।

গ্রামগঞ্জের স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা আরও খারাপ। সেখানকার হাসপাতাল বা ক্লিনিক নামে যা রয়েছে তাতে চিকিৎসাসেবা দেয়ার মতো তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই চিকিৎসা প্রদানের প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র। এমনকি অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার পর্যন্ত নেই। শহরের জীবনযাপনে অভ্যস্ত চিকিৎসকরা অনেকে গ্রামগঞ্জে পোস্টিং নিয়ে যেতে চান না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যাদের গ্রামের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে পড়ে থাকতে হয় তাদের মাঝে দেখা যায় পেশার প্রতি চরম অনীহা। এসবের ব্যতিক্রম চিকিৎসক যারা রয়েছেন তারা হতাশ, কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

অতি সম্প্রতি আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ঘাতকব্যাধি ক্যান্সার আক্রান্ত বন্ধুটি বাংলাদেশের অনেক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় করে বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়ে শেষ অবধি আমার দেশপ্রেমিক বন্ধুটি চিকিৎসা করাতে বিদেশে গমনে বাধ্য হন। বিদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্বন্ধে তার মধুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। শুধু আমার বন্ধুটিই নন, অনেক আগে আমারই এক নিকট আত্মীয়া ব্যাংককের একটি হাসপাতালে দাঁতের চিকিৎসা নিতে গিয়ে সেখানকার উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি ডাক্তার ও নার্সের সেবা-যত্নের কথা আজও ভুলতে পারেননি। এখনও তিনি মনে রেখেছেন হাসপাতালের শুভ্র বিছানা, জানালার ধবধবে পর্দা ভেদ করে আসা প্রতিদিনের প্রভাত সূর্যের নরোম রোদ ফুলদানি থেকে আসা রজনীগন্ধার মিষ্টি গন্ধ।

দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের বিনিময়ে গড়া এ দেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো। একজন চিকিৎসক তৈরি করতে রাষ্ট্রের ব্যয় হয় অঢেল অর্থ। তাই রোগীর প্রতি, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি একজন চিকিৎসকের দায়ভার রয়ে গেছে অনেক। আর চিকিৎসাসেবা এক মহান পেশা। এ পেশায় নিয়োজিতদের আত্মত্যাগের মনোভাব থাকতে হয়। নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ছাড়া কখনও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না।

অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চেয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসকগণ নিঃসন্দেহে কিছুটা বেশি সুবিধা ভোগ করেন। তারা সরকারি দায়িত্ব পালনের পরও অবসর সময়ে কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে বা নিজস্ব চেম্বারে রোগী দেখে বাড়তি উপার্জন করতে পারেন। বিত্তশালী যারা বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিতে চান না তারা বিশাল অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে চিকিৎসকগণ প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে বাড়তি আয়ের নেশায় মেতে উঠবেন এটা যেমন বেআইনি তেমনি অমানবিক।

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে দেশের সরকার হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রদানসহ প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান নিয়োগ, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নিয়মিত সরবরাহ এবং চিকিৎসকদের আধুনিক চিকিৎসা দানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী। আজ দেশে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। হার্ট সার্জারিতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের মতো কঠিন অপারেশনও সম্ভব করে তুলেছেন এদেশের চিকিৎসকরা। এসব সফলতা দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি জনমানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনবে। সামান্য রোগ শোকের জন্য চিকিৎসা নিতে বাংলাদেশের বিত্তবান রোগীদের কষ্ট করে বিদেশ গমনের প্রবণতা কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে গুটিকতক চিকিৎসকের লোভ লালসার কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থার যে দুর্নাম হচ্ছে তার দায়ভার থেকে মুক্ত হতে দেশের সচেতন চিকিৎসক সমাজকে রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানোন্নয়নে তাদের নিতে হবে দৃঢ় পদক্ষেপ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত