গত বুধবার ২ এপ্রিল ছিল ১৮তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ২০২৫। অটিজম বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো স্নায়ুবৈচিত্র্যের অগ্রগতি এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনকে চিন্তা করে ‘আমার ইতিবাচক অটিজম পরিচয়’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে অটিজম সচেতনতা দিবস বাংলাদেশেও পালন করা হয়। সারা বিশ্বে আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে দিবসটি পালন করা হয়। অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশু ও বয়স্কদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ২ এপ্রিলকে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকে প্রতিবছর দিবসটি পালন করা হচ্ছে। অটিজম নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকরা অটিজমকে কোনো রোগ বলতে রাজি নন, বরং তারা বলছেন অটিজম হলো একরকম কন্ডিশন তথা স্থিতি। মানসিক স্থিতি ও বিভিন্ন আচরণগত সমস্যাকে একসঙ্গে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বলা হয়। অটিজম মূলত মানব শিশুর নিউরো ডিজঅর্ডার ডেভেলপমেন্ট বা স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যা। শিশুর জন্মের প্রথম দুই-তিন বছরের মধ্যেই অটিজমের সাধারণ লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। অটিজম এমন একটি বিকাশজনিত সমস্যা, যার ফলে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির অন্য মানুষ বা বিষয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকে না। সবসময় একা থাকতে পছন্দ করে, আত্মীয় পরিজন বা বাইরের লোকের উপস্থিতিতে বিরক্ত হয়, সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে, অন্য কারও সঙ্গে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, অস্বাভাবিকভাবে তাকিয়ে থাকে, আনন্দ অনুষ্ঠানে অংশ নেয় না, সারাক্ষণ নিজের খেয়ালে ডুবে থাকে, ডাকলে সাড়া দেয় না, খুব দেরিতে কথা বলে, কথা বললে বুঝতে পারে না বা অনুসরণ করতে পারে না, একই কথা বারবার আওড়াতে থাকে, ইশারা বুঝতে পারে না, একই জায়গায় ঘুরপাক খেতে থাকে, অস্বাভাবিক আচরণ করে, একা একা অকারণে হাসে, ভয়ের অনুভূতি থাকে না, বোধ-বুদ্ধিতে অসাড়তা দেখা দেয়। এছাড়া সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, ভাষা ও আবেগীয় বিষয়গুলোও পরিলক্ষিত হয় না অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর মধ্যে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর শতকরা ৭০ ভাগেরই আইকিউ ৭০-এর নিচে থাকলেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান, দক্ষ ও পারদর্শী হয়ে থাকে। অধিকাংশ অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর স্বাস্থ্যও স্বাভাবিক থাকে। তাদের মস্তিষ্ক বিকৃত নয়, বরং তারা প্রখর মেধার অধিকারী হয়ে থাকে। তাই এ ধরনের শিশুদের সাধারণত বিশেষ শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অটিজমের প্রকৃত কোনো কারণ বের করতে পারেনি। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এতটুকু পর্যন্ত পৌঁছেছে যে, অটিজম একটি জীনগত সমস্যা। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এই বিশেষ শিশুদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা আছে। যেহেতু অটিজম কোনো অস্বাভাবিকতা নয়, তাই অনেক ক্ষেত্রেই অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা অসাধারণ হয়। তাই যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে সেটা বিকশিত করে দেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে রাষ্ট্রকে। যেন মেধা বিকাশের মাধ্যমে তারাও সমাজকে কিছু উপহার দিতে পারে। একটি রাষ্ট্র তখনই কল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যখন প্রত্যেক নাগরিকের জন্য যথাযথ সুযোগ-সুবিধা বজায় থাকে। যদিও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই মানুষেরা অধিকাংশই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি বুঝতে পারে না কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মাথায় রাখতে হবে তাঁরাও এদেশের সম্মানিত নাগরিক। দেশে ঠিক কতজন শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এর সঠিক পরিসংখ্যান এখনও নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ ২০২১-এ বলা হয়, মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠী। আবার ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠী দেখানো হয়েছে। উল্লিখিত দুই জরিপে দেখা যায়, ২০২১ সালের তথ্যমতে মোট প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা ৪৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৪১ জন। আবার ২০২২-এর তথ্যমতে ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০৪ জন। আবার সমাজসেবা অধিদপ্তরের চলমান প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ৭২৭ জন, যারা সরকারের সেবা সনদ প্রাপ্তির জন্য স্বীকৃত। এতে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি শনাক্তকরণ ও তার পরিসংখ্যান সঠিক ও সার্বিকভাবে হচ্ছে না। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলমান প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ অনুসারে দেশে নিবন্ধিত অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৮৬ হাজার ১৪২জন। তন্মধ্যে ছেলে ৫২ হাজার ৮৩৮ জন ও মেয়ে ৩৩ হাজার ২৫০ জন। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি রয়েছেন ৫৪ জন। অন্যদিকে ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) তথ্য বলছে, গ্রামের চেয়ে শহরে অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪ জন এবং শহর এলাকায় প্রতি ১০ হাজারে ২৫ শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। মেয়ে শিশুর চাইতে ছেলে শিশুর মধ্যে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বেশি। কিন্তু এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে খুব সহজ চিন্তায় দ্বিমত পোষণ করা যায়। গ্রামীণ জনপদে অসচেতনতা এবং অর্থনৈতিক কারণে এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অটিজম শনাক্তকরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনও মনে করে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তি জিন বা ভূতের আসরের শিকার। কিংবা এও মনে করা হয় তারা পাগল। শুধু গ্রাম কেন, শহরের অনেকেই এরকম ধারণা পোষণ করে। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং সচেতনতার কারণে শহরে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিকদের তুলনামূলক সহজে শনাক্তকরণ করা সম্ভব হয়। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সাধারণত মৃদু, মাঝারি ও গুরুতর এই তিনভাগে বিভক্ত করা হয়। এদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপি, সাইকোলজিক্যাল ম্যানেজমেন্ট থেরাপিসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা হয়। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নের এই চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল যা দেশের ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সক্ষমতার বাইরে। তাই দেশের বড় একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী সমীক্ষার বাইরে থেকে যায়। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয় যা রাজধানী ঢাকা শহরের বাইরে নেই বললেই চলে। অল্প যে কয়েকটি বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে সেগুলোও অনেক ব্যয়বহুল। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমোদনক্রমে যেসব বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে সেগুলোতেও যথাযথ রাষ্ট্রীয় তদারকির অভাব পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষা সাধারণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হওয়ার কথা কিন্তু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিকদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অর্থাৎ এখানেও পক্ষান্তরে রাষ্ট্রের নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে কল্যাণের চোখে দেখা হচ্ছে। যা স্পষ্টই রাষ্ট্রের নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত। উন্নয়নের এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে দেশের সবার অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই নাগরিকদের সঠিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে একসময় তারা দেশের উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থায়ী আবাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নাগরিকদের জন্য বড় পরিসরে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র তাত্ত্বিকভাবে আলোচনা না করে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ভবিষ্যতে চাকরির উপযোগী করে গড়ে তুলতে বিশেষ শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে। অটিজমে বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নাগরিকদের উপেক্ষা করা স্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। এজন্য অটিজম সম্পর্কে সাধারণ নাগরিকদের মাঝে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। আর এর একমাত্র উপায় হলো অটিজমের পাশাপাশি প্রতিবন্ধিতার সব বিষয়গুলোকে জাতীয় পাঠ্যক্রমের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অন্তর্ভুক্ত করণ। মানব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ আমাদের সমাজ জীবন। সামাজিক জীবনে অভ্যস্থ হয়ে যে সমাজে আমরা বসবাস করছি সেখানে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। জীবনধারণে কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। রঙে, কথায়, আচরণে, চলাফেরায় , চিন্তা-চেতনায় মিল নেই। প্রতিভাও সবার সমান নয়। শুধু কি তাই- উচ্চতা, আয়-ব্যয়, পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থাতেও কত বৈচিত্র্য আমাদের। আমাদের মধ্যে কেউ উদার, কেউ অনুদার; কেউ কোমল, কেউ রাগী; কেউ অন্তর্মুখী, কেউ বহির্মুখী। ঠিক তেমনি একটি বৈচিত্র্যের নাম অটিজম। সমাজে বসবাস করতে গিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতির জন্য আমরা যেমন ভিন্ন চিন্তার মানুষকে সম্মান করি, ঠিক একই কারণে অটিজম বৈশিষ্ট্যের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত। আর এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও যথাযথ অধিকার প্রদানের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ‘সূবর্ণ নাগরিক’ পরিচয়পত্র প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই পরিচয়পত্রের মাধ্যমে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। দেশের অটিজম ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে যথাযথ অধিকার রক্ষা ও কল্যাণের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা’ আইন পাস করা হয়। আইনটিতে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের পূর্ণমাত্রায় বেঁচে থাকা ও বিকশিত হওয়া; সর্বক্ষেত্রে সমান আইনি স্বীকৃতি এবং বিচারগম্যতা; উত্তরাধিকার প্রাপ্তি; স্বাধীন অভিব্যক্তি; মতপ্রকাশ এবং তথ্যপ্রাপ্তি; পরিবারের সঙ্গে সমাজে বসবাস; বিয়ে ও পরিবার গঠন করা; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ; শিক্ষার সবস্তরে একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণ; সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্তি; কর্মজীবনে প্রতিবন্ধিতা শিকার ব্যক্তির কর্মে নিয়োজিত থাকা বা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি; সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি; সবক্ষেত্রে উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি; সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ; ব্যক্তি তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা; জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি; ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি এবং ভোট প্রদান ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তির পরিপূর্ণ জীবন লাভের জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে যেসব সহযোগিতা প্রয়োজন, তার সবকিছুই এই আইনের দ্বারা স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই আইনের আওতায় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের অধিকার ও আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয় ও নির্বাহী কমিটি এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার নেতৃত্বে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ আইনের ৩৩(১) ধারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনের কথা বলা হয়েছে। আইনের এ ধারায় বলা হয়েছে যে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্তৃপক্ষ ওই ব্যক্তির, অন্যান্য যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভর্তির আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। কোনো বৈষম্য ঘটলে, বৈষম্যের শিকার প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট কমিটির কাছে অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। এছাড়া প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ করে এ বিষয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থাকে আইনি ভিত্তি দেয়া হয়েছে। দিবসটিতে কেবল অটিজম নয়, এর সঙ্গে সচেতনতাও যুক্ত। অটিজম সচেতনতার কাজটি সামাজিক কাজ। এর মধ্যে তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৩ সালের সুরক্ষা আইনের ফলে শিক্ষা, সামাজিক ক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্রসহ অন্যান্য সবক্ষেত্রে অটিজম ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের কষ্ট লাঘবে যতখানি ভূমিকা রাখার কথা ছিল বাস্তবতা তার তুলনায় ভিন্ন। এখনও শিক্ষাক্ষেত্রে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আইনটিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে এবং শিক্ষা বোর্ডগুলো পরীক্ষা গ্রহণে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করলেও মাঠপর্যায়ে এর যথাযথ প্রয়োগ এখনও হতাশাজনক। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫, ১৭, ২০ এবং ২৯নং অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের অন্যান্য নাগরিকদের মতোই সমান সুযোগ ও অধিকার লাভের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকার ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে রাষ্ট্রের দায়িত্বের অংশ হিসেবে প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচি চালু করেছে। প্রাথমিকভাবে ১০৪১৬৬ জন প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিকে প্রতি মাসে ২০০/- টাকা হারে ভাতা দেয়া হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ২৯ লাখ থেকে ৩২.৩৪ লাখে উন্নীত হয়েছে। মাসিক ভাতার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫০/- টাকা। সম্পূর্ণরূপে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল একজন প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের পক্ষে ৮৫০ টাকায় বর্তমান বাজারে কিছুই করা সম্ভব নয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় প্রতিবন্ধী ভাতা ৫০০০ টাকা, নেপালে প্রতিবন্ধিতার মাত্রার ভিত্তিতে ২ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত, ভারতের দিল্লিতে ২ হাজার ৫০০ রুপি, পাকিস্তানে ২ হাজার রুপি। আমাদের দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫। আর মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫০০ ডলারের উপরে চলে গেছে সেখানে সমাজের দুর্বল বা পিছিয়েপড়া প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা ৮৫০ টাকায় জীবন অতিবাহিত করবেন এটা সভ্য সমাজে চিন্তা করাও পাপ। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই জনগোষ্ঠীর মাসিক ভাতা ন্যূনতম ৫০০০/- টাকায় উন্নীত করা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য প্রতিবন্ধিতার সাথে অটিজমের একটি পার্থক্য হলো যত কম বয়সে অটিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হবে, ততই দ্রুত শিশুকে স্বাভাবিক আচরণে ফিরিয়ে আনার সুযোগ বেশি থাকবে। এর জন্য অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষা পদ্ধতি ভালো ফল দেয়। তাদের যে কোনো জটিল বিষয়কে সহজ-সরলভাবে ধাপে ধাপে উপস্থাপন করে শেখানো যায়, তবেই তারা তা সহজে বুঝতে ও আয়ত্তে আনতে পারে। বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মাধ্যমে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাদান করা যেতে পারে। তবে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনায় তা খুবই ব্যয়বহুল। যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে এই শিশুদের বিভিন্ন বিষয় শেখানো সম্ভব। সামাজিক দক্ষতা অর্জন পদ্ধতির মাধ্যমেও তাদের সামাজিক আচরণ শেখানো যায়। সর্বোপরি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের খুব দ্রুতই স্বাভাবিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অভিযোজিত করে তোলা সম্ভব। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। এই দায়িত্ব শুধু পরিবারের একার নয়, এটা আমার, আপনার, গোটা জাতির তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার। আমাদের দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক, প্রথাগত, গোষ্ঠীগত, ভাষাগত, জাতিগত, জন্মগত নানা কারণে সমাজের মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-মূর্খ, অগ্রসর-অনগ্রসর, ধর্ম-গোত্র, রাজনৈতিক ধারা-মতবাদসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমরা দেখছি বৈষম্যের বিচিত্র রূপ। সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হয় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগণ। আমরা সবাই যদি সচেতন থাকি, তবেই এরা ভবিষ্যতে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখতে পারবে।
যদিও বাস্তবিক জীবনে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অসহযোগিতা মূলক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখা দরকার অটিজম বৈশিষ্ট্য সন্তান কেনো বয়স, ধর্ম, স্থান, কাল, পাত্র ভেদে পরিবারে অতিথি হয়ে আসে না। আজ হয়তো আমি, আপনি তাদের অবহেলার চোখে দেখছি কিন্তু এই আমি আপনিই আগামীদিনে মা-বাবা, চাচা-মামা, খালা-ফুফু, দাদ-নানা, দাদি-নানি বা আপনজন হতে যাচ্ছি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সামাজিকভাবে এখনও তাদের জীবন ব্যবস্থাপনাকে কল্যাণের চোখে দেখা হয়; কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে জনসাধারণের মধ্যে এই ধারণার প্রচার ও প্রসার ঘটানো যে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি হলো তাদের ন্যায্য অধিকার। যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে পরিবারের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি), নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা।