ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আরবদের ভাবতে হবে

আবুল খায়ের বাবু
আরবদের ভাবতে হবে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসে তার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গাজা দখলের ডাক দিলে গোটা বিশ্বময় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বাধ্য হয়ে পরিকল্পনা থেকে পিছু হটলেও তার বরকন্দাজ রক্তপিপাসু দানব নেতানাহুকে দিয়ে গাজায় গণহত্যা চালিয়ে জনশূন্য করার সব কার্যক্রম চলমান রেখেছে। যুদ্ধবিরতির নামে সময়ক্ষেপণ করে ইজরাইলকে অস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে শক্তিশালী করেছে। ইজরাইলকে যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করে আবারও গাজায় আক্রমণের অনুমোদন দিয়েছে। দখলদার দানব নেতানাহুর বাহিনী এখন গাজা জনশূন্য করার সঙ্গে সঙ্গে ভূমি দখলের জন্য পশ্চিমতীরেও ধংসলীলায় মেতেছে। রমজান মাস এমনকি ঈদের দিনও তাদের বোমার আঘাতে ধ্বংস আর হত্যাকাণ্ড করা বাদ যায়নি। রেডক্রসের নিরিহ কর্মীদের হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় গুলি করে গণকবর দিয়েছে। কাতার-মিসরের যুদ্ধবিরতি চুক্তি হামাস সম্মত হলেও নেতানাহু বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে গাজাবাসীকে এলাকা ত্যাগ করার আদেশ দিয়ে তার ধংসযজ্ঞ আর হত্যাক- চলমান রেখেছে। খাদ্যত্রাণ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে গাজাবাসীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। অবস্থা দেখে মনে হয় সভ্যবিশ্বের কোথাও যেন কেউ নেই এই দানব থামাবার, মানবতা রক্ষা করার, গণহত্যা বন্ধ করার।

ট্রাম্প যুদ্ধবিরতিতে রাজী না হলে হামাসকে হুমকি দিয়েছিল যে, নরকের সব দরজা দিয়ে আগুন নামিয়ে আনবে। হামাস সেই চুক্তি মানলেও ইজরাইল তা কখনও মানেনি। আমেরিকা পরমানু ইস্যু নিয়ে ইরানকে আক্রমণ করে ধ্বংস করার হুমকি দিয়েছে। সৌদি আরব সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত ইরান আক্রমণে তাদের ভূমি ও আকাশসীমা আমেরিকাকে ব্যবহার করতে দেবে না জানিয়ে দিয়েছে। আমেরিকা তাই ভারত মহাসাগরের দিয়াগোগাসিয়া ঘাঁটিতে সমরসজ্জা বাড়াতে শুরু করেছে। ইরানও বসে নেই সেও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে ইজরাইলকে ধ্বংস ও আমেরিকান সেনাদের কফিনে ফেরত পাঠানোর। আমেরিকার ইয়ামেন আক্রমণ, ইজরাইলের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে লেবাননে আক্রমণের মাধ্যমে পুরা মধ্যপ্রাচ্য আবার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

এমন যুদ্ধের ডামাডোলে সিবিএস নিউজ জানিয়েছে আগামী মে মাসের মধ্যবর্তী সময়ে ট্রাম্প দ্বিতীয়বারে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম তার অফিসিয়াল সফরে সৌদি আরব যাচ্ছেন। বর্তমান অবস্থায় সৌদি আরব হোয়াইট হাউসের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচানায় সৌদি আরবকে ভেন্যু হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। ট্রাম্পের সফরের লক্ষ্য সৌদিসহ ও অন্য আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়ন, গাজার যুদ্ধবিরতি এবং আমেরিকায় সৌদির প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ। সেইসঙ্গে ট্রাম্প জামাতার আব্রাহাম চুক্তি সম্প্রসারণের চেষ্টা করা ও সৌদি আরব ইজরাইল সম্পর্ক উন্নয়ন। যা কি না সৌদি আরবের স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া ইজরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা নেই শর্ত এবং ইজরাইলের তা না মানায় থমকে আছে।

ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতায় বসে বিশ্বব্যাবস্থায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ফেলেছেন। গাজার সঙ্গে সঙ্গে আগ্রাসী আক্রমণকারীর মতো পানামাখাল, গ্রীনল্যান্ড এবং কানাডার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার হুমকি দিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষধে ইউক্রেন এবং মিত্রদের রাশিয়াকে আগ্রাসী বাহিনী বলে আনীত বিলের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। ন্যাটো মিত্রদের আমেরিকার অর্থনীতির খুব বেশি সুবিধাভোগী বলে শুল্ক আরোপ করে মিত্রদের আস্থায় ফাটল ধরিয়েছেন। তারা কেউ আর এখন আমেরিকার উপর ভরসা রাখতে না পারায় নিজেদের নিরাপত্তায় পারমানবিক অস্ত্র ক্ষমতা বাড়াতে শুরু করেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইউক্রেনে অস্ত্র-গোলাবারুদ প্রযুক্তিসহ সব সহায়তা দিয়ে পাশে থাকা আমেরিকা ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে ইউক্রেনকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থায় আমেরিকার প্রদত্ত সাহায্যের বিনিময় ইউক্রেনের মূল্যবান খনির অংশ দাবি করেছে। ইউক্রেন তাতেও রাজি এবং আরো সাহায্যের তাগাদায় হোয়াইট হাউসে ওভাল অফিসে আলোচনায় ট্রাম্প ভলোদিমি জেলনস্কি একেবারেই বিরল উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে।

গত মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চেয়ারে বসে ঠিক প্রায় একই সময়ে ট্রাম্পের প্রথম সৌদি সফর দেখেছি। তার সফরকালে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ইরানের জুজুর ভয় দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব রক্ষার জন্য সৌদি আরবকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করা হয়েছিল। আরব নেতাদের বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সৌদি নেতাদের এমন কিছু বুঝিয়েছিলেন যার জন্য ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার পরপরই সৌদি নেতৃত্বাধীন পাঁচটি দেশ কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। এমনকি রমজান মাসে কাতারে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। কারণ কাতার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করছে। শোনা গিয়েছিল কাতারকে বিচ্ছিন্ন করার পর, এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে ট্রাম্প টুইট করেছিলেন যে, এটি তার মধ্যপ্রাচ্য সফরের সাফল্য। কারণ সমস্ত পদক্ষেপই মার্কিন-ইসরায়েলের পক্ষে। এই নীতি অনুসরণ করে আমেরিকা আরব দেশগুলোতে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছে। আরব নেতারা বিশ্বাস করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের রক্ষা করবে এবং ক্ষমতায় থেকে আমৃত্যু আরামদায়ক জীবন উপভোগ করবেন। নিঃসন্ধে বলা যায় সেই বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র গোলাবারুদ আরব নিধনে ব্যবহার হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় যে দলই আসুক তাদের সবারই পররাষ্ট্রনীতি মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলকে রক্ষা করা তাকে একচ্ছত্র ক্ষমতাধর করে মধ্যপ্রাচ্যের নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা। বাইডেনের সময় দেখেছি তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ব্লিঙ্কেন যুদ্ধ বিরতিতে কাজ না করে ইসরায়েলি যুদ্ধ মন্ত্রিসভার নেতার মতো ভূমিকা পালন করতে। মধ্যপ্রাচ্যে তার শাটল সফরে আরব নেতাদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন। আরব নেতারা ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় একতাবদ্ধ হতে পারেনি। আরব নেতাদের মধ্যে বিভাজন এবং তাদের নীরবতা, নিরপেক্ষতায় হলোকাস্ট থেকে বেঁচে আসা ইহুদিদের তৈরি ইসরায়েল আজ রক্তপিপাসু দানব রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, দানব নেতানিয়াহু ফাঁকা মাঠে ওয়াকওভার নিয়ে ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এখনও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ।

আরব নেতাদের বুঝতে হবে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয়রা কখনওই আরবদের বন্ধু হতে পারে না, বন্ধু কেবল তখনই হয় যখন আরবদের বিভক্ত করতে প্রয়োজন হয়। যখন একে অপরকে হত্যা করতে তাদের সামরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অনুপ্রাণিত করতে এবং অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে হয়। আরব ভূমিতে মার্কিন ঘাঁটি কেবল তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে এবং ইসরায়েলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরবদের জন্য নয়।

তাই আরব রাষ্ট্রের মার্কিন ঘাঁটি থেকে ইজরাইল সুবিধা পায় কিন্তু ইজরাইল লক্ষ্য করে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র আকাশসীমা লঙ্ঘনের কারণ দেখিয়ে তা ধ্বংস করে ইজরায়েলকে রক্ষা করা হয়। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর দ্বৈত ভূমিকাও লক্ষ্য করেছি। তারা রাশিয়ান আগ্রাসন বন্ধ করতে ইউক্রেনকে সমস্ত সহায়তা প্রদান করছে কিন্তু একই সঙ্গে তারা ফিলিস্তিনি গণহত্যার জন্য রক্তপিপাসু দানব ইসরায়েলকে সমস্ত ধরনের লজিস্টিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে।

মার্কিন-যুক্তরাজ্য নেতৃত্বাধীন জোটের আশীর্বাদে ইসরায়েল গাজাকে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি কসাইখানা হিসেবে প্রস্তুত করেছে। যেখানে ফিলিস্তিনিরা এখন তাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তাদের সর্বস্ব উৎসর্গ করছে। ফিলিস্তিনিরা এ যুদ্ধ যেন কেবলমাত্র ইসরায়েলের সঙ্গে নয়, মার্কিন-যুক্তরাজ্য জোটের সঙ্গেও এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত। সম্ভবত কোনো অলৌকিক ঘটনা ছাড়া ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার আর কোনো সুযোগ এবং সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ইতিহাস হয়তো কোনো একদিন বলবে যে, ফিলিস্তিনিরা কেবল ইসরায়েলের সঙ্গেই নয়, বরং স্বাধীন ফিলিস্তিনের জন্য বিশ্বের মানবতার মুখোশধারী শক্তিধর জোটের সঙ্গে লড়াই করে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে। তারা বেছে নিয়েছিল ভেড়ার মতো দীর্ঘ জীবনযাপন করার জন্য বেঁচে থাকার চেয়ে অনেক অনেক বেশি উত্তম একদিন সিংহের মতো বেঁচে থাকা। সময় এখন আরব নেতাদের বিবেক জাগ্রত করার। সময় এখন শিয়া-সুন্নি নানা বিভেদ ভুলে একতাবদ্ধ হওয়ার, সময় এখন পশ্চিমাদের উপর নির্ভরতা কমানোর। সময় এখন আরব ভূমি থেকে সব বিদেশি ঘাঁটি বন্ধ করার। সময় এখন একতাবদ্ধ আরব একক শক্তি নিয়ে ইজরাইলকে ফিলিস্তিন ভূমি থেকে নিজ সীমান্তে ফেরত যেতে বলার। আরব নেতারা কি করবে এখন তারা কি গাজাকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কবরস্থান বানাতে দেখবে? ট্রাম্পের কুটচালে ক্ষমতায় থেকে আমরণ সুখভোগের জন্য নিজেদের মাঝে বিভেদ রেখে ইরানকে ধ্বংস করতে সহযোগিতা করবে? ইরানের পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংস করলে আমেরিকানদের কিছু হবে না প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর জনজীবনে বিপর্যয় ঘটতে পারে। আরবদের ভাবতে হবে। আমাদের কিছুই করার নেই শুধু কেবলই পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে মানবতা রক্ষার প্রার্থনা করতে পারি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত