ঢাকা শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ২৮ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভারতের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় শিলিগুড়ি করিডোর এবং বিমসটেক সম্মেলন

শামসুন্নাহার লাভলী
ভারতের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় শিলিগুড়ি করিডোর এবং বিমসটেক সম্মেলন

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্ট্রাটেজিক পয়েন্ট হচ্ছে শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেক। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সরাসরি যোগাযোগের একমাত্র স্থলপথটি পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি চিকেন নেক হয়ে বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার এই চিকেন নেক পলিসি ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। সম্প্রতি চীন সফরকালে কথা প্রসঙ্গে, প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূস বলেন, সেভেন সিস্টার্স ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ড লকড) একটি অঞ্চল, সাগরের সঙ্গে যার সরাসরি যোগাযোগ বা প্রবেশের সুযোগ নেই। তাই, বাংলাদেশই হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের অভিভাবক। (যদিও এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, ড. ইউনূসের বক্তব্যকে ভূলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে) সম্ভবত ডক্টর ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতের এই অঞ্চলকেই দুই দেশের বার্গেইনিংয়ের ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার মনে করেন আর তাই চিকেন নেক নিয়ে স্ট্রাটেজিক কৌশলের কারণে ভারতের কাছে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডরের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তাই ভারত চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি কড়িডোরে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে ।

এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে ভারত কেন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সবসময় উদ্বিগ্ন সেটা অমর মতো করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব-বাংলাদেশ সাধীন হবার পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নানা ধরনের টানাপড়নের মধ্যে দিয়ে চলে এসেছে, বাংলাদেশের ৫৪টা নদীর পানি বণ্টন, সীমান্ত সমস্যা, তিনবিঘা করিডর সমস্যা, বাণিজ্য ঘাটতি সমস্যা ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা ছিল, শুধু করিডর সমস্যার সমাধান হয়েছে। আরও একটি খুব বড় সমস্যা বাংলাদেশের ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, যেটার কৃতিত্ব ভারত নিতে চায়, ভারতী চলচিত্রে ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে দেখায়। এছাড়াও বাঙালি জাতি ভাসার জন্য ৯ মাস ধরে যুদ্ধ করল কিন্তু ভারত মাত্র ৭-৮ দিন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধের পুরো কৃতিত্ব নিয়ে নেয়। এই যে ৯ মাস ধরে বাংলার আপামর জনতা খেয়ে না খেয়ে আধা পেট খেয়ে যুদ্ধ করল তার কোনো কৃতিত্ব তারা দিতে নারাজ।

আরও একটা কৌশল নেয় ভারত সবসময় সেটা হলো- বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে শাসন ও শোষণের কৌশল বের করে ‘রাও’কে দিয়ে বাংলাদেশকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যেন বাংলাদেশ কোনো দিন বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এর কারণ কি ? এর পেছনে কাজ করে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজি, সেটা হলো ভারতের অখণ্ডতা রক্ষা। যদি বাংলাদেশর বিষয়ে ভারত মাথা না ঘামায়, বা ‘র’কে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করতে চায়, তাহলে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে, আর বাংলাদেশ যদি সর্ব ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটিয়ে একটা ভালো পর্যায়ে পৌঁছে যায় তাহলে ভারতের অন্যান্য রাজ্য যারা স্বাধীন হতে চায়, তারা আরও উৎসাহী হবে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে। ভারতের সেভেন সিস্টারসসহ অন্য যেসব রাজ্য স্বাধীন হতে চায় তারা কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন হতে চাইবে। সেই কারণেই বাংলাদেশ ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, অন্যান্য যা কারণ আছে সেগুলো গৌণ। ভারত বাংলাদেশকে কখনও স্থিতিশীল হতে দেয়নি এবং হাসিনাকে ‘র’কে দিয়ে ট্রেইনআপ করে বাংলাদশে প্রিপ্লান মেসাকার করেছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিনই হাসিনা ভারতে চলে যান। তিন দিন পর সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তখন থেকেই বিভিন্ন কারণে দুই দেশের মধ্যে অস্বস্তি এবং সম্পর্কের টানাপড়েন চলে আসছে। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব নেয়ার পর এর আগেও দুই দফা মোদির সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাদের বৈঠক হয়ে ওঠেনি। কারণ মোদি কোনোভাবেই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বসতে আগ্রহী হননি। থাইল্যান্ডের মোদি-ইউনূস বৈঠক হচ্ছে না বলে জানিয়ে দিয়েছিল ভারত। কিন্তু এরই মধ্যে মোদি একবার নয়- দুবার চিঠি লিখেছেন ড. ইউনূসকে। একবার ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আবার ৩১ মার্চ ঈদুল ফিতর উপলক্ষে। দুবারই বার্তা দিয়েছেন দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় করতে আগ্রহী তিনি। মোদি দুই দেশের বন্ধুত্ব দৃঢ় করতে চান কিন্তু বৈঠকে বসতে চান না। মোদি কেন ডক্টর ইউনূসের সঙ্গে বসতে ভয় পান? কারণ হতে পারে হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার পর, ভারতীয় মিডিয়াকে দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সমন্ধে অপ-প্রচার চালিয়েছে, পররাষ্ট্র নীতি আর দলীয় ধর্মীয় উগ্রবাদ মিশিয়ে লেজেগোবরে করে ফেলেছে মোদি এবং এটাকে কীভাবে ব্যালেন্স করতে হবে সেটা বুঝতে না পেরে বৈঠকে বসতে কখনও রাজি হয়নি, ইউনূসের সেভেন সিস্টার নিয়ে হুমকির কারণে যখন দেখলেন পানি গলা পার হয়ে নাকে ঠেকেছে তখন তিনি রাজি হলেন বৈঠকে বসতে, এটার প্রমাণ মিলে টাইমস অফ ইন্ডিয়া রিপোর্টে- জানানো হয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এই সাতটি রাজ্যকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক এক মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। সেভেন সিস্টার্সকে আঞ্চলিক সংগঠন বিমসটেকের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মন্তব্য করেছেন মোদি। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে আয়োজিত ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়ার আগে মোদি এ মন্তব্য করেন বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া। এই বক্তব্যের মাধ্যমে বিমসটেক অঞ্চলে সেভেন সিস্টার্সের গুরুত্বের দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ইউনূসের এই কৌশল কতটা নাকানি-চুবানি খাইয়েছে মোদিজিকে। তাই তিনি সঙ্কিত হয়েছেন ভারতের অখণ্ডতা নিয়ে আর তাই বৈঠকে বসতে রাজি হওয়ার পাশাপাশি এই অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করেছেন।

সম্প্রতি ভারতীয় সেনাপ্রধানের দেয়া এক বিবৃতিতে করিডরের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের অবস্থান আরও সুস্পষ্ট হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘চিকেন নেক’ কোনো দুর্বল জায়গা নয়, বরং এটি ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক অঞ্চল। ভারতীয় সেনাবাহিনী শিলিগুড়ি করিডরকে তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ত্রিশক্তি কর্পসের সদর দপ্তর করিডরের কাছে শুকনায় অবস্থিত। এই কর্পস আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় সজ্জিত।

চিকেন’স নেকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ২০১৭ সালে, ডোকলাম অচলাবস্থার সময়। সে সময় ভারতীয় বাহিনী ভুটানের ভূখণ্ডে চীনের রাস্তা নির্মাণের প্রচেষ্টা প্রতিহত করেছিল। এই সড়ক শিলিগুড়ি করিডরকে বিপন্ন করতে পারত। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা নিয়ে ওই অঞ্চলে ভারত তার প্রতিরক্ষা পরিকাঠামো আরও জোরদার করছে।

অর্থাৎ ডক্টর ইউনূস এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সফল সরকারপ্রধান যার পররাষ্ট্র নীতির কৌশলে ভারত নতজানু। আর তাই বিমসটেক সম্মেলনে সাইড লাইনে মিটিংয়ে বসবেন দুদেশের প্রধান। বিমসটেক বা বে-অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেকটোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন হচ্ছে একটি আঞ্চলিক সংগঠন। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি দেশের সমন্বয়ে এটা গঠিত। (ব্যাংকক সম্মেলনের পর বিমসটেকের পরবর্তী সভাপতিত্বের দায়িত্ব পাবে বাংলাদেশ), বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো, এই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বৈঠকে হাসিনার প্রত্যার্পণ, ভারতে বসে উনি (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন আক্রমণাত্মক মন্তব্য করছেন, সেসব বিষয়ে কথা বলেছেন এবং সীমান্ত হত্যা, গঙ্গা চুক্তি নবায়ন এবং তিস্তা নদীর পানিবন্টন নিয়েও কথা বলেছেন ।

মোদির সব চেষ্টাই ইউনূসের সততা, সাহস ও মেধার কাছে বুমেরাং হয়েছে। পত্রপত্রিকায় বৈঠকের যে ছবি চাপা হয় তাতে দেখা যায়, মোদির হাত কাঁচুমাচু করে বসা বডি ল্যাঙ্গুয়েজই তার পরাজয়ের ইঙ্গিত দেয়। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ও হুমকি দেয়া হয়েছে, ভিসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, এমনকি পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে চাপ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার শক্ত পররাষ্ট্র নীতির কাছে মোদির পরাজয় হয়েছে। এভাবে কৌশল অবলম্বন করে ভারতের সঙ্গে কলোম্যান সব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন আশাকরি প্রধান উপদেষ্টা এসব দীপক্ষীয় সমস্যার সমাধান করতে পারবেন ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত