রাজনীতি, যার মূল লক্ষ্য হলো জনগণের সেবা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সমতা নিশ্চিত করা, আজকের দিনে বাণিজ্যিকীকরণের শিকার হয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে অর্থ, ক্ষমতা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের গভীর সংযোগ একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ, মতামত এবং স্বার্থের প্রতিফলন। কিন্তু যখন রাজনীতি বাণিজ্যিক স্বার্থ দ্বারা চালিত হয়, তখন গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যেখানে রাজনীতি জনসেবার পরিবর্তে ব্যক্তিগত বা কর্পোরেট স্বার্থ পূরণের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। এতে অর্থের আধিপত্য বৃদ্ধি পায় এবং রাজনীতি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। নির্বাচনি প্রচারণায় বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয়, দলীয় তহবিল সংগ্রহে অনৈতিক পন্থা অবলম্বন এবং রাজনৈতিক নেতাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়া- এসবই রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে নির্বাচনে প্রার্থীদের বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করা একটি সাধারণ ঘটনা। প্রার্থীদের অনেকেই ভোটারদের কাছে প্রভাব বিস্তারের জন্য অর্থ ব্যয় করেন, যা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। নির্বাচিত হওয়ার পর সেই অর্থ পুনরুদ্ধার করতে এবং মুনাফা অর্জনের জন্য প্রভাবশালী পদগুলোকে ব্যবহার করা হয়।
বাণিজ্যিকীকরণের নেতিবাচক প্রভাব: রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ একটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য মারাত্মক হুমকি। নীতিহীন অর্থনৈতিক স্বার্থ যখন রাজনীতির চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়, তখন জনগণের কল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ অগ্রাধিকার পায়। এতে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয় এবং সামগ্রিকভাবে জাতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়: রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে। গণতন্ত্রের মূলনীতি হলো জনগণের ইচ্ছা ও মতামতের প্রতিফলন। কিন্তু যখন অর্থ এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে, তখন এই মৌলিক নীতিগুলো প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। সৎ এবং যোগ্য নেতাদের জন্য রাজনীতিতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ তারা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে পারেন না বা কর্পোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে ক্ষমতার আসনে পৌঁছানোর পথ খুঁজে পান না। ফলস্বরূপ, রাজনীতিতে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং ধনী ব্যক্তিদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে। এতে প্রকৃত জনগণের প্রতিনিধিত্ব হ্রাস পায় এবং গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার ধারণাটি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়: রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ দুর্নীতির জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে। নির্বাচনি প্রচারণার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয়ের ফলে প্রার্থীরা নির্বাচিত হওয়ার পর সেই অর্থ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। এর ফলে ঘুষ এবং সরকারি প্রকল্পের তহবিল আত্মসাতের মতো কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক পদকে প্রায়শই একটি লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয়, যেখানে নির্বাচনে জয়লাভের পর পদমর্যাদার মাধ্যমে সেই বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করা হয়। সরকারি ক্রয় বা উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম, দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং অর্থনৈতিক নীতিতে পক্ষপাতিত্ব দুর্নীতির সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়ায়। যখন রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তখন তা সমাজে একটি নেতিবাচক উদাহরণ স্থাপন করে। তরুণ প্রজন্ম এবং প্রশাসনের সদস্যরা এই আচরণকে গ্রহণযোগ্য মনে করতে শুরু করে। এর ফলে সমাজের সব স্তরে দুর্নীতির প্রসার ঘটে।
জনস্বার্থ অবহেলিত হয়: রাজনীতি যখন ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়, তখন জনগণের প্রকৃত চাহিদা এবং কল্যাণ উপেক্ষিত হয়। জনকল্যাণমূলক প্রকল্প এবং নীতিনির্ধারণে জনগণের মতামত বা অংশগ্রহণ তেমন গুরুত্ব পায় না। বাংলাদেশসহ অনেক দেশে দেখা যায়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা হয় না। কারণ, রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই এমন প্রকল্পে আগ্রহী হন, যেখানে তারা সরাসরি আর্থিক লাভ করতে পারেন। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কর্মসূচি প্রায়শই পিছিয়ে পড়ে। এছাড়া, জনগণের চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিবর্তে রাজনৈতিক নেতারা সেসব প্রকল্পে মনোযোগ দেন, যা তাদের ব্যক্তিগত সুনাম বৃদ্ধি করে। ফলে প্রকৃত জনকল্যাণ নিশ্চিত হয় না এবং সামাজিক অগ্রগতির গতি মন্থর হয়ে পড়ে।
সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়: রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ ধনী ও প্রভাবশালীদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। এতে দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। ধনী প্রার্থীদের বিপুল অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা থাকার কারণে তারা নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। ফলস্বরূপ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ধনী এবং ক্ষমতাধরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এর ফলে সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ হয়ে যায়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বহীনতার কারণে তাদের সমস্যাগুলো সংসদ বা নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব পায় না। এর ফলে সমাজে এক ধরনের আস্থাহীনতা এবং হতাশা তৈরি হয়, যা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি।
নির্বাচন ব্যবস্থার অবমূল্যায়ন: রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর। নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। কিন্তু অর্থের ব্যবহার এই প্রক্রিয়াকে প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে ধনী প্রার্থীরা ভোটারদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। ভোট কেনাবেচা, ভীতি প্রদর্শন এবং নির্বাচনি প্রচারণায় অর্থের অস্বাভাবিক ব্যবহার নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে কলুষিত করে। এর ফলে সৎ এবং যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়লাভ করতে ব্যর্থ হন। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হওয়ার পরিবর্তে এটি একটি আর্থিক প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়। এর ফলে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং জনগণের ভোটাধিকারের প্রতি আস্থা কমে যায়।
গণতন্ত্র রক্ষায় করণীয়: রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ গণতন্ত্রের প্রকৃত শক্তিকে ক্ষয়িষ্ণু করে তুলেছে। যখন অর্থ ও ক্ষমতার প্রভাব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন গণতন্ত্র তার প্রকৃত গুণাগুণ হারায়। জনগণের স্বার্থরক্ষা এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে রাজনীতি হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত লাভ এবং ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার। এই প্রেক্ষাপটে, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ রোধে কী কী করণীয়, তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।
লেখক : শিক্ষার্থী; মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ।