মানুষের দুর্দশা দেখলে সুযোগ সন্ধানী একদল মানুষের চোখ চক চক করে উঠে। এরা মানুষের দুর্দশা বিক্রি করে আর্থিক ও সামাজিকভাবে লাভবান হতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। মানুষের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে, মামলা মোকদ্দমা না থাকলে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা অন্য কিছু হতো। আমাদের পণ্ডিত ব্যক্তিরা দুর্দশা বিক্রির নাম দিয়েছেন সেবা। দুর্দশা লাঘবকারীরা বেশির ভাগ সময়ই আগ্রাসী হয়ে উঠে। দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি নিঃস্ব না হওয়া পর্যন্ত কেউ কেউ থামতে ও চান না। রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল জনসাধারণের দুর্দশা লাঘব করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করার জন্য। দুর্দশা লাঘবে জনসাধারণ রাষ্ট্রকে কর দেয়।
কর সংগ্রহকারী ও দুর্দশা লাঘবকারীরা হলো সরকার। এই সরকার গঠিত হয় জনগণের সমর্থনে। সরকার যখন জনগণের দুর্দশা লাঘবে ব্যর্থ হয় কিংবা শিথিলতা দেখায় তখন একদল লোক স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে। এদের মধ্যে তিন ধরনের মানুষ রয়েছে। প্রথম দল নিজেদের মহৎ, দানশীল, পরোপকারী, বিবেকবান মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে চায়, দ্বিতীয় দল মহৎ কাজের আড়ালে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালায়, তৃতীয় দল দুর্দশা লাঘবের জন্য সরাসরি টাকা পয়সা গ্রহণ করে।
আমাদের আর্থসামাজিক কাঠামোতে অধিকাংশ প্রবীণ দুর্দশা গ্রস্থ। তাদের মানসম্মত খাবার, আরামদায়ক বাসস্থান, সুচিকিৎসা, সুস্থ বিনোদনের চরম ঘাটতি রয়েছে। দেশে প্রায় দুই কোটি প্রবীণের মধ্যে প্রায় ষাট লাখ প্রবীণ বয়স্ক ভাতার আওতায় এসেছে। ভবিষ্যতে প্রবীণের জীবন শান্তি পূর্ণ এবং স্বস্তিদায়ক করতে সার্বজনীন পেনশন স্কীম চালু হয়েছে। প্রবীণের চলমান সংকট ভবিষ্যতে এতটা তীব্র না থাকার সম্ভবনা প্রবল। বর্তমানে প্রবীণের দুর্দশা কীভাবে বিক্রি হয় তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই। পরিবারে প্রবীণের প্রথম দুর্দশা বিক্রি শুরু হয়। প্রবীণ কার কাছে থাকবেন? কে দেখা শোনা করবে? কেমন খরচ পড়বে? টাকা পয়সা কে কত দেবে?
প্রবীণ যদি স্বচ্ছল হন তবে পরিবারের সদস্যরা মোটামুটি সহযোগিতা করে। প্রবীণ আর্থিকভাবে দুর্বল হলে নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকলে পরিবারের সদস্যরা এককভাবে কিংবা অংশ বিশেষ বহন করে। দুর্দশাগ্রস্ত প্রবীণের টাকার দরকার হলে পরিবারের সদস্য কিংবা বাইরের লোকজনের কাছে সহায় সম্পদ বিক্রি করতে হয়।
সমাজের কিছু লোক প্রবীণের দুর্দশা লাঘবে বৃদ্ধাশ্রম, প্রবীণ নিবাস তৈরি করেন। সেগুলো পরিচালনা করার জন্য অনেক সময় জনগণের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণ করতে হয়। কখনো কখনো বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণ নিবাস বানানোর জন্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে দান, অনুদান নিতে হয়। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে প্রবীণ নিবাস গড়ে উঠছে।
সমাজের কিছুসংখ্যক মানুষ প্রবীণের কল্যাণে, অধিকার আদায়ে বেশ সোচ্চার থাকেন তারা সভা-সমাবেশ মিছিল-মিটিং, আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, মানব বন্ধন, কর্মশালার আয়োজন করে থাকেন। এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক রয়েছে যারা বড় বড় হাসপাতালগুলোর সাথে সমঝোতা স্মারক সই করে নিজস্ব বলয়ের প্রবীণদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। প্রবীণের দুর্দশা লাঘবে বহুতল ভবন নির্মাণ, কমিউনিটি সেন্টার, হাসপাতাল নির্মিত হলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যক্তি বিশেষের মর্জির উপর পরিচালিত হয় কিংবা বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীরা প্রবীণদের দুর্দশা লাঘবে নানান ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়। সরকারি অনুদান, বয়স্ক ভাতা, ফ্রি-চিকিৎসা ইত্যাদির সুযোগ-সুবিধার কথা বলে। জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনি ইশতেহারে প্রবীণদের জন্য কি করা হবে, সে বিষয়ে ঘোষণা দেয়। নির্বাচনি ইশতেহারে দেয়া ওয়াদা পূরণ হয়েছে কি না, এসব প্রশ্ন মাঝেমধ্যে কেউ কেউ করে থাকেন।
ব্যক্তিগতভাবে প্রবীণের দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে দুর্দশা দূর করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বিপুলসংখ্যক প্রবীণ প্রতিদিন চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য উপস্থিত হন। সিরিয়াল পাবার বিড়ম্বনা, লাইনে দাঁড়ানোর যন্ত্রণা, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, ইসিজি, এক্স-রে, আল্ট্রা-সাউন্ড, সিটি স্ক্যান, এমআরআই রিপোর্ট সংগ্রহ করে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধপত্র সেবন অনেক কষ্টকর একটি কাজ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বড় ধরনের খরচ বেশির ভাগ প্রবীণের জন্য পীড়াদায়ক। বাসাবাড়িতে শারীরিক-শারীরিক অসুস্থতার জন্য দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদনে সাহায্যকারী প্রয়োজন হয়। প্রশিক্ষিত পেশাদার এসব সেবাকর্মীদের সেবা গ্রহণে উচ্চ মূল্য পরিশোধ করতে হয়। বিছানা বন্দি প্রবীণের সেবা ব্যয়বহুল এবং কিছুটা বিরক্তিকর। সবচেয়ে দুর্দশা গ্রস্ত প্রবীণ হলো যারা কানে শুনে না আবার চোখে ও দেখে না। যে প্রবীণের দুর্দশা যত বেশি তাকে বেঁচে থাকার জন্য ততবেশি টাকা খরচ করতে হয়। এই দুর্দশাকে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষ বেশ ভালো রকমের রোজগার করতে পারেন। চিকিৎসা খরচ এখন বেশি এবং ওষুধের দাম ও বেশি ফলে দুর্দশা পাল্লা দিয়ে বাড়ে।
প্রবীণ জীবন কে শান্তি পূর্ণ এবং স্বস্তিদায়ক করতে প্রবীণের দুর্দশা লাঘবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর যারা দুর্দশা বিক্রি করে আর্থিক এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায় তাদের দমন করতে হবে। দুর্দশা গ্রস্ত প্রবীণের দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করলে প্রবীণ প্রতারণা, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাবে।