ঢাকা বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দুই রাষ্ট্র প্রধানের বৈঠক

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কোন পথে?

লাভলী শামসুন্নাহার
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কোন পথে?

ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইড লাইনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের সম্পর্কের ‘উত্তেজনা হ্রাস করতে। বৃহস্পতিবার থাই প্রধানমন্ত্রী সিনাওয়াত্রার নৈশভোজে ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি পাশাপাশি বসেছিলেন। গত শুক্রবার দুপুরে দুই নেতা পার্শ্ববৈঠকে মিলিত হয়েছেন। ড. ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর এটিই দুই নেতার মধ্যে প্রথম বৈঠক। বৈঠকে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

গত শুক্রবার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সাংরিলা হোটেলে আধা ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলমান ওই বৈঠকে শীর্ষ নেতাগণ অতীত আর বর্তমানের বিষয়গুলো সামনে এনেছেন দুই দেশের সম্পর্কের স্বার্থে। আলোচনায় ডক্টর ইঊনূস এবং মোদি যে বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন সেগুলোর উপর আলোকপাত করা যাক-

ডক্টর ইঊনূস-হাসিনার প্রত্যার্পণ, ভারতে বসে উনি (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন ইনসেনডিয়ারি (আক্রমণাত্মক) মন্তব্য করছেন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়ন এবং তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়েও কথা বলেছেন বৈঠকে।

নরেন্দ্র মোদির আলোচনায় ছিল- সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অর্থাৎ অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন, জে কোনো ধরনের রেটোরিক এছাড়াও শেখ হাসিনার স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়ার বিষয়টিও এসেছে। এখন দেখা যাক মোদিজির চাওয়া কতটুকু যৌক্তিক-

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ এখানে শুধু হিন্দু লোকজন থাকে না, মুসলমানের সাথে এদেশে খ্রিষ্টান, বৌদ্ধরাও বাস করে সেখানে মোদি সবসময় মাইনরিটি মনে করে হিন্দুদের আসলে হাসিনাকে দিয়ে বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন, তাই সেটা এখনও ভুলতে পারেননি, এখনও মনে করেন, এদেশ তাদের অঙ্গরাজ্য সেজন্য বারবার হিন্দু নির্যাতনের ধুয়া তুলেন, হাসিনা পতনের পর গোদই মিডিয়া দিয়ে হিন্দু নির্যাতনের বয়ান তৈরি করেছিলেন। এখনও মনে করেন এদেশের হিন্দুরা তার। আবার মোদিজি এদেশের অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন চান, হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে তিনি এদেশের নির্বাচনের বারটা বাজিয়ে এখন সুষ্ঠু নির্বাচন চান, কতটুকু যৌক্তিক? উনি কেন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে উদ্বীগ্ন? ভারত তার বহু বছরের ঐতিহ্য ভেঙেছে, সামরিক প্রধান কখনও সামনে এসে বক্তব্যও দেয় না; কিন্তু এবার দেখলাম ভারতের সেনাপ্রধানকে দিয়েও বলিয়েছেন বাংলাদেশের ইন্টুইশন নির্বাচন চায়।

মোদি যেকোনো ধরনের রেটোরিক অর্থাৎ প্ররোচনামূলক বক্তব্য বন্ধ চান, তার তো নিজেরাই বাংলাদেশ আর ডক্টর ইউনূস নিয়ে অপপ্রচার চালা এবং প্ররোচনামূলক আচরণ এখনও আছে, ভারতে তীব্র আন্টি ইউনূস ফিলিং কাজ করে। অপরদিকে ইউনূস চেয়েছেন হাসিনাকে ফেরত দিক ভারত, এটা কি সম্ভব? না এটাও সম্ভব নয়। কারণ হাসিনাকে দিয়ে যত অপকর্ম করিয়েছে তা ফাঁস হয়ে যাবার ভয় আছে। হাসিনাকে দীর্ঘদিন ধরে ‘ট্রেনিং দিয়ে বাংলাদেশে মেসাকার করতে পাঠিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় এটা প্রায় সত্যে পরিণত হয়েছে, যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে জুলাই বিপ্লব, শাপলাচত্বর গণহত্যা, বিডিআর কিলিং থেকে শুরু করে সমস্ত খুন-গুম এবং আরও অপকর্ম এর সাথে মোদির তথা ভারতের সম্পৃক্ততা ফাঁস হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত ইমেজসংকটে পড়বে এবং আন্তর্জাতিক আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। মোদি এটা কোনো দিন চাবে না।

ইউনূস সীমান্ত হত্যা বন্ধ হোক চেয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডে তিনি সব সময় কষ্ট অনুভব করেন। ভারতকে এই ঘটনাগুলো প্রতিরোধের জন্য উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, প্রাণহানির সংখ্যা কমাতে একসঙ্গে কাজ করলে অনেক পরিবার বড় ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে না, বরং আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে সাহায্য করবে। এটাও কি সম্ভব? সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্ বলেছে সীমান্তে গরু চোরা চালানকারীদের প্রকাশনে গুলির অর্ডার দেয়া উচিত। ফলে সীমান্তহত্যা বন্ধ হবে, এমনটা বিশ্বাস করা যায় না।

অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন বিষয়েও কোনো ফলপ্রসূ অগ্রগতি হবে না। কারণ ভারত মনে করে তাদের পানি প্রয়জন। আর মমতা ব্যানার্জি যদি পানি দিতো তাহলে তিস্তা সমস্যার সমাধান বহু আগেই হত। ইউনূসকে চীনের দিকে হাত বাড়াতে হত না। ভারতের কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে ফলে, পানি বাংলাদেশকে দেবে না। সুতরাং পানি সমস্যারও কোনো সমাধান আসবে না। আরেকটা কথা না বললেই নয়, ডিপ্লোম্যাসিতে বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মোদি অন্যান্যা বিশ্ব নেতাদের সাথে দেখা হলে জড়িয়ে ধরেন যেমন- পুতিন, ট্রাম্প, বেঞ্জামিন এদের, কিন্তু ইউনূসকে তিনি জড়িয়ে ধরেননি সংগত কারণেই। তাই ইউনূসের সাথে করমর্দনও ছিল নিষ্ক্রিয়।

ইঊনূস এসব আগে থেকে বুজতে পেরেছিলেন বলে চীনের সাথে পানি বিষয়ে ৫০ বছরের প্ল্যান করেছেন। তিস্তা প্রজেক্ট চিনকে দিবেন, ফলে হাসিনার সময়ে তিস্তা প্রজেক্ট ভারতকে ডিয়ার কোথা ছিল সেটা আর হবে না।

ভারত চিরদিনের জন্য তিস্তা প্রজেক্ট হারালো। শুধু তাই নয়, চীন যখন তিস্তা প্রজেক্টে কাজ করবে, তখন শিলিগুঁড়ি করিডর তথা চিকেন নেক নিয়ে তিন দেশের মধ্যে টেনশন বাড়বে। চীন তার কর্মীদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য ওই অঞ্চলে সেনা মোতায়েন করবে, যেমনটা পাকিস্তনে করেছে ফলে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হতে পারে। এছাড়া ভারতীও অনেক চ্যানেলে এরই মধ্যে বলেছেন, ওই অঞ্চলে আনছারুলা বাংলা টিম, হিজবুল্লা তাহেরই, জামাত মিলে নাশকতা করতে পারে। এসবই ইঙ্গিত বহন করে অস্থিতিশীল ভবিষ্যতে।

মোংলা পোর্ট ভারতকে দিয়েছিল হাসিনা ইউনূস, এটা ভারতে থেকে নিয়ে চিনকে দেবে ফলে ভারত এটিও হারাল। চীন যদি ওই অঞ্চলে কাজ শুরু করে তাহলে মোংলার পাশে রয়েছে ভারতের বন্দর সেটা কলকাতার হলদিয়া বন্দর? তাহলে সেখানেও ত্রিদেশিও টানাপড়েন শুরু হবে।

আরেকটা বিষয় নজরে আনা প্রযোজন, সেটা হলো হাসিনা ক্ষমতায় থাকা কালে প্রায়ই বলত. খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের কথা। আমেরিকা নাকি ত্রিপুরা, বার্মার কিছু অংশ আর বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন নিয়ে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বানাতে চায়, এটা যদি আমেরিকা করতে চায় ভারত, বার্মা আর বাংলাদেশের সাহায্য নিয়ে, উদ্দেশ্য থাকবে চীনকে প্রতিহত করা, তাহলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চল আগুনে রূপান্তরিত হবে। চীন অবশ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আর কালচারাল ডিপ্লোমেসিকে আলাদাভাবে করে- সেক্ষেত্রে হয়তো যতটা ঝুঁকির কথা ভাবছি, ততটা নাও হতে পারে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, দুই দেশের সম্পর্ক এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তরে যোগাযোগটা জরুরি ছিল। মিটিং হয়েছে কতটা ফলপ্রসূ হবে বলা মুশকিল; কিন্তু আঞ্চলিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করতে হলে এই অঞ্চলে টেনশন তৈরি করে ফলাফল ভালো হবে না, তাই ভবিষ্যতে চীন যদি বাংলাদেশের সাথে কাজ করে, তবে ওইসব অঞ্চলগুলোতে যেন চীন কোনোভাবে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি না করে, সেটা প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইঊনূসকে চীনের সাথে আলোচনায় বসে ঠিক করে নিতে হবে। এখন সময়ই বলে দেবে, সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে, কে কতটা উদ্যোগী ভূমিকা নিচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত