একবিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চালচিত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। সেটি হলো আঞ্চলিক সহযোগিতা। রাজনৈতিক সীমারেখা যতই থাকুক না কেন, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, জলবায়ু কিংবা মানবিক সংকট—সব কিছুই এখন বহুদেশীয় বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে। আর এই বাস্তবতাকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে নানা আঞ্চলিক জোট ও ফোরাম, যেগুলো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন গড়ে তুলছে। এই প্রেক্ষাপটে বিমসটেক (বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) হলো এমন একটি আঞ্চলিক জোট, যা বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী দেশগুলোর মধ্যে একটি টেকসই ও সুশৃঙ্খল সহযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে এগিয়ে চলছে। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই জোটের প্রধান লক্ষ্য হলো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, কারিগরি এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক দৃঢ় করা। বিশ্ব যখন বৈশ্বিক পরাশক্তির দ্বন্দ্বে, অর্থনৈতিক মন্দা, এবং জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি, তখন এই ধরনের আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্মগুলো আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বিমসটেক কেবল একটি জোট নয়, এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আস্থার নববসুন্ধারা। এটি এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে ছোট-বড়, ধনী-গরিব সকল দেশ একত্রে বসে নিজেদের উন্নয়নের পথ রচনার সুযোগ পাচ্ছে।
বিমসটেকের গঠন ও সদস্য দেশসমূহ : বিমসটেকের সদস্য দেশগুলো হলো: বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, নেপাল এবং ভুটান। এই সাতটি দেশ একদিকে দক্ষিণ এশিয়া, অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেতুবন্ধন রচনা করছে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে এই দেশগুলোর অবস্থান বঙ্গোপসাগরের চারপাশে, যার কারণে এই অঞ্চলটি কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রয়েছে বিপুল মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, সমুদ্র বাণিজ্যের পথ এবং প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা। প্রতিষ্ঠার শুরুতে বিমসটেক কেবলমাত্র চারটি দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড) মধ্যকার একটি সহযোগিতা ফোরাম ছিল। ধীরে ধীরে এর পরিধি বৃদ্ধি পায় এবং বাকি তিন দেশ এতে যোগ দেয়। বর্তমানে এটি সাত দেশের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত একটি পূর্ণাঙ্গ আঞ্চলিক জোট। বিমসটেকের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি ভৌগোলিক সীমানার চেয়ে অর্থনৈতিক ও কার্যক্রমভিত্তিক অংশীদারিত্বকে গুরুত্ব দেয়। যেখানে সার্ক কিংবা আসিয়ান রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতায় প্রায়শই থমকে যায়, সেখানে বিমসটেক বাস্তবসম্মত, কার্যকর ও লক্ষ্যভিত্তিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে আগ্রহী। এটি মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তি, জ্বালানি, পরিবহন, জলবায়ু, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানসহ ১৪টি খাতে কাজ করে যাচ্ছে। বিমসটেকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি সচিবালয়, যার সদর দপ্তর ঢাকায় অবস্থিত—যা বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত গুরুত্বেরই প্রতিফলন। সচিবালয়টি সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলন : এক নতুন দিশা : সম্প্রতি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেকের ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলন। এই সম্মেলন ছিল বহুমাত্রিক তাৎপর্যপূর্ণ- একদিকে যেমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সূচনা, অন্যদিকে ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্ধারণ। এই সম্মেলনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল ‘ব্যাংকক ভিশন ২০৩০’ গ্রহণ। এই নীতিদলিলের মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো পরবর্তী দশকের জন্য একটি সুসংগঠিত রোডম্যাপ নির্ধারণ করেছে। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, ডিজিটাল সংযোগ, সবুজ অর্থনীতি ও জলবায়ু মোকাবিলায় সম্মিলিত পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। এমনকি এটি বিমসটেককে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আরও কার্যকর করে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছে।
ব্যাংকক সম্মেলনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বাংলাদেশের জন্য। এই শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ আগামী দুই বছরের জন্য বিমসটেকের চেয়ারশিপ গ্রহণ করেছে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গর্বের, আবার দায়িত্বেরও। নেতৃত্বে থাকাকালীন, বাংলাদেশ বিমসটেককে একটি আরও কর্মমুখী ও ফলপ্রসূ জোটে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে—এমন আশা করা যায়। এছাড়াও সম্মেলনে নিরাপত্তা সহযোগিতা, অবকাঠামো সংযোগ, ডিজিটাল রূপান্তর এবং জলবায়ু অভিযোজনসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আলোচনায় উঠে এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতা এবং ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা—যেগুলো বিমসটেক সদস্যদের জন্যও একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করছে। এ প্রেক্ষাপটে যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
বিমসটেকের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : বিমসটেকের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আঞ্চলিক জোটগুলোর প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে, এবং বিমসটেক সেই প্রয়োজন পূরণে একটি সম্ভাবনাময় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী অবস্থানে থেকে এই জোট এমন একটি মঞ্চ তৈরি করেছে, যেখানে সদস্য দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং নিরাপত্তাবিষয়ক স্বার্থে সহযোগিতা করতে পারে। ব্যাংকক ভিশন ২০৩০ নামক যে দৃষ্টিভঙ্গি দলিল সম্প্রতি গৃহীত হয়েছে, সেটি বিমসটেকের ভবিষ্যৎকে নতুন দিগন্তের দিকে নিয়ে যাবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
এই ভিশনের আওতায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নৌ ও স্থল সংযোগ, টেকসই শক্তি ব্যবহার, ডিজিটাল অর্থনীতি, জলবায়ু অভিযোজন এবং মানবসম্পদ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই রূপরেখা কেবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, বাস্তবভিত্তিক। এতে সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে আঞ্চলিক স্বার্থকে যুক্ত করে একটি সামগ্রিক উন্নয়ন কৌশল গড়ে তুলতে পারবে। এছাড়া ভবিষ্যতে বিমসটেকের কার্যক্রম আরও ফলপ্রসূ ও গতিশীল করতে গেলে এর কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। বর্তমানে বিমসটেকের সচিবালয় ঢাকায় অবস্থান করলেও এর বিভিন্ন খাতে বিশেষায়িত সেল প্রতিষ্ঠা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য তহবিল গঠন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নিয়মিত কার্যনির্বাহী বৈঠক, এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি।
আরেকটি সম্ভাবনাময় দিক হলো, বিমসটেকের মাধ্যমে একাধিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে একসূত্রে বাঁধা সম্ভব হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত এবং থাইল্যান্ড- দুই ভিন্ন আঞ্চলিক বলয়ের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি- এই একই মঞ্চে কাজ করছে। একইভাবে নেপাল ও ভুটানের মতো স্থলবেষ্টিত দেশগুলো তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থকে বাস্তবায়নের জন্য এক্সেস টু সি (Access to Sea) সুবিধা পাচ্ছে। বিমসটেক তাই একটি ‘বিনিময় ও সমন্বয়ের হাব’ হয়ে উঠতে পারে, যেখানে বড় ও ছোট দেশ সবাই নিজের জায়গা করে নিতে পারে।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও কূটনৈতিক কৌশল : বিমসটেকের সদস্যপদ বাংলাদেশের জন্য শুধু সম্মানজনক নয়, কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ এমন এক অবস্থানে রয়েছে, যেখান থেকে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি কার্যকর সেতুবন্ধন তৈরি করা সম্ভব। বিমসটেক সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে একটি দুর্দান্ত সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রথমত, অর্থনৈতিক দিক থেকে বিমসটেক বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বাজার সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত যেমন তৈরি পোশাক, ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য- এসব পণ্যের জন্য বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোতে বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে বিমসটেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যের পরিমাণ অপ্রতুল হলেও, একটি অঞ্চলভিত্তিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর করা গেলে বাংলাদেশের রপ্তানি বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে বিমসটেকের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক সহযোগিতা বাংলাদেশকে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে পারে। ভারত, ভুটান ও নেপালের জলবিদ্যুৎ, মিয়ানমারের গ্যাস এবং থাইল্যান্ডের নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস বাংলাদেশকে একটি টেকসই জ্বালানি কাঠামো গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে। এই দিকটিকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের শিল্প খাত আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে। তৃতীয়ত, সংযুক্তির দিক থেকেও বিমসটেক বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। ‘বিমসটেক করিডোর’ নামে পরিচিত সড়ক ও রেল সংযোগ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ সহজেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে প্রবেশ করতে পারবে।