ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সমাজের রূপান্তর ও আমাদের দায়বদ্ধতা

হৃদয় পান্ডে
সমাজের রূপান্তর ও আমাদের দায়বদ্ধতা

সমাজ কোনো বিচ্ছিন্ন ধারণা নয়, এটি মানুষ দ্বারা নির্মিত এবং মানুষই এর কেন্দ্রে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন একটি সামাজিক পরিবেশ, যেখানে সে নিরাপত্তা, ভালোবাসা, মর্যাদা ও সহানুভূতির সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারে। সমাজ মানুষকে তার শেকড় চিনতে শেখায়, সংস্কৃতি ধারণ করতে শেখায় এবং একটি নৈতিক কাঠামোর মধ্যে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তখনই কার্যকর হয়, যখন প্রতিটি মানুষ তার দায়িত্ব পালন করে। একজন মানুষের আচরণ, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ শুধু তার নিজের ওপর নয়, সমগ্র সমাজে প্রভাব ফেলে। আমরা যখন রাস্তায় আবর্জনা ফেলি, তা শুধু পরিবেশ নয়, সমাজের নাগরিকচেতনার প্রতিফলনও ব্যর্থ করে তোলে। সমাজ যতটা না বড় কোনো রাষ্ট্র কাঠামো, তার চেয়েও বেশি একটি মানসিক ও মানবিক বন্ধনের জায়গা। এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজ গঠনে প্রত্যেকটি মানুষের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

সমাজের রূপান্তর ও প্রযুক্তির প্রভাব : বর্তমান যুগে সমাজের রূপান্তর একটি অনিবার্য বাস্তবতা। বিশেষ করে প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন আমাদের সামাজিক সম্পর্ক, যোগাযোগের ধরন, জীবনের রীতি-নীতি এমনকি মূল্যবোধেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এক সময় পরিবার ছিল সামাজিক শিক্ষার প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র; আজ প্রযুক্তি সেই স্থানটি অনেকাংশে দখল করে নিচ্ছে। স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এর ফলে একদিকে যেমন বিশ্বের সাথে সংযুক্ত থাকা সহজ হয়েছে, অন্যদিকে আত্মিক সংযোগ, সহানুভূতি ও মানবিক সংবেদনশীলতা অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যক্তি আজ তার ঘরের মধ্যেই একা, বন্ধুত্ব হয়ে উঠেছে ভার্চুয়াল, আর পরিবারের উষ্ণতা অনেকটা ঠাণ্ডা পর্দার আলো-আঁধারিতে হারিয়ে যাচ্ছে। সমাজের এই রূপান্তর শুধু প্রযুক্তির কারণে নয়, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলও বটে। আমরা প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ না করে, প্রযুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছি। ফলে সমাজে যে বন্ধন, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির বুনন ছিল, তা ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু।

মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সমাজে তার প্রতিফলন : আজকের সমাজে সবচেয়ে বড় সংকট সম্ভবত মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। আমরা একদিকে প্রযুক্তির উৎকর্ষে গর্বিত, কিন্তু অন্যদিকে একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, সহনশীলতা ও শ্রদ্ধার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। মন্দের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কমে গেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পাই। শিশু নির্যাতন, নারী নিপীড়ন, প্রবীণ অবহেলা কিংবা প্রতিবেশীকে অমানবিক আচরণ- এসব এখন যেন সাধারণ খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ কিংবা সামাজিক রীতিনীতিও আজ আর মানুষের মানবিকতা জাগাতে যথেষ্ট নয়। এক সময় ‘পরের জন্য বাঁচা’ ছিল সমাজের মূলমন্ত্র, এখন ‘নিজেকে বাঁচাও’ এই প্রবণতা শক্তিশালী। এই অবস্থায় সমাজ শুধু ভৌত কাঠামোতে নয়, নৈতিক দিক থেকেও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। অথচ মানবিক মূল্যবোধই সমাজকে বাঁচিয়ে রাখে, এগিয়ে নেয়। এই অবক্ষয় ঠেকাতে আমাদের শুধু আইন নয়, দরকার আত্মিক পরিবর্তন, নৈতিক জাগরণ এবং পারস্পরিক দায়িত্ববোধের চর্চা।

সামাজিক বৈষম্য ও শ্রেণিবিভাগ : সমাজে বৈষম্য সব সময়ই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিরাজমান। কিন্তু বর্তমান সময়ের বৈষম্য শুধু আর্থিক নয়, তা বিস্তৃত হয়েছে শিক্ষাগত, প্রযুক্তিগত, সাংস্কৃতিক এমনকি সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও। শহর ও গ্রাম, ধনী ও দরিদ্র, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত, এমনকি প্রযুক্তি-সচেতন ও প্রযুক্তি-বঞ্চিতদের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে, তা সমাজে এক গভীর অসাম্যরেখা টেনে দিয়েছে। ধনীদের সন্তানরা উন্নত স্কুলে পড়ে, প্রযুক্তির সব সুবিধা ভোগ করে আর দরিদ্রের সন্তানেরা এখনো দুর্বল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শিকার। এই শ্রেণিবিভাগ শুধু সুযোগে সীমাবদ্ধ নয়, মানসিকতাকেও প্রভাবিত করে। ধনী শ্রেণির ভোগবিলাস যখন দরিদ্রের চোখে পড়ে, তখন হিংসা, অসন্তোষ ও অবিশ্বাস জন্ম নেয়। এই অদৃশ্য দেয়াল সমাজকে শুধু বিভক্তই করে না, কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাকেই দুর্বল করে দেয়। সমাজ তখন আর সমতার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকে না, বৈষম্যের ভারে নুয়ে পড়ে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দরকার ন্যায্য বণ্টন, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়ন, যেখানে প্রতিটি নাগরিক সমান গুরুত্ব ও সম্মান পায়।

নাগরিক দায়িত্ব ও সামাজিক সচেতনতা : সমাজের উন্নয়ন কেবল রাষ্ট্র বা সরকারের কাজ নয়, প্রতিটি নাগরিকের নিজের দায়িত্ব ও ভূমিকাও এখানে অপরিহার্য। নাগরিক দায়িত্ব মানে সমাজের প্রতি এক গভীর দায়বদ্ধতা, যা প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজেও প্রতিফলিত হওয়া উচিত। একজন মানুষ যখন রাস্তা পরিষ্কার রাখে, বয়স্কদের সম্মান করে, বাচ্চাদের সুশিক্ষা দেয় কিংবা প্রতিবেশীর বিপদে পাশে দাঁড়ায়, তখন সে শুধু একজন ভালো মানুষ নয়, একজন সচেতন নাগরিকও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজে এই সচেতনতা এখনো পর্যাপ্তভাবে গড়ে ওঠেনি। অনেকেই ভাবেন, সমাজের উন্নয়ন সরকারের কাজ অথচ সমাজ গড়ে ওঠে মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায়। নাগরিকরা যদি তাদের কর্তব্য ভুলে যান, তাহলে শুধু প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে সমাজ এগোতে পারে না। সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে দরকার শিক্ষার বিস্তার, গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা এবং পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষার চর্চা। কারণ নাগরিক যদি সচেতন না হয়, তাহলে কোনো সমাজই প্রকৃত অর্থে সভ্য হতে পারে না।

সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ : প্রযুক্তির এই জোয়ারে আমরা যেভাবে আধুনিকতার নাম করে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ করছি, তাতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। ফ্যাশন, বিনোদন, খাদ্যাভ্যাস এমনকি ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা আমাদের শিকড় থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছি। অথচ একটি জাতিকে টিকে থাকতে হলে তাকে তার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরতেই হবে। আমাদের সাহিত্য, সংগীত, লোককথা, লোকনৃত্য এবং প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, এগুলো আমাদের আত্মপরিচয়ের অংশ। সমাজে যখন নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা কমে যায়, তখন মানুষ নিঃস্বত্বা অনুভব করে এবং এই শূন্যতা থেকে অপরাধ, হতাশা ও আত্মবিচ্ছিন্নতা জন্ম নেয়। তাই আজ দরকার আমাদের শিকড়ে ফিরে যাওয়া, তরুণদের মাঝে সংস্কৃতি চর্চার আগ্রহ তৈরি করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দেশীয় ভাবনার প্রতিফলন ঘটানো। শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয় সংস্কৃতির পুনর্জাগরণই পারে সমাজকে সজীব ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে।

শেষকথা : সমাজ একটি জীবন্ত সত্তা, যার প্রতিটি কোষ হলো তার নাগরিকরা। এই সমাজের কাঠামো, মনস্তত্ত্ব, অর্থনীতি এবং নৈতিক ভিত্তি- সবই নির্ভর করে মানুষের আচরণ ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধের ওপর। আজকের বিশ্বায়নের যুগে সমাজের রূপ প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নতুন চ্যালেঞ্জ, আবার খুলে যাচ্ছে নতুন সম্ভাবনার দুয়ারও। বৈষম্য, অবচেতন নাগরিকত্ব, মূল্যবোধের ক্ষয় এবং সংস্কৃতির ভাঙনে সমাজ যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের উপায় লুকিয়ে আছে আমাদের চেতনায়, চিন্তায় এবং কর্মে। আমরা যদি চাই একটি ভারসাম্যপূর্ণ, ন্যায্য ও নৈতিক সমাজ গড়ে তুলতে, তাহলে প্রয়োজন সামাজিক দায়বদ্ধতা, আত্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ ভালোবাসা। এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, সমাজ মানে প্রতিদিনের জীবনচর্চায় আমাদের আচরণই সমাজকে গঠন করে। তাই নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত, শুধু নিজেদের উন্নতির কথা না ভেবে বৃহত্তর সমাজের কল্যাণে ভাবা, কাজ করা এবং তরুণ প্রজন্মকে একটি মানবিক ও মূল্যনির্ভর সমাজের চিত্র দেখানো। সমাজের প্রকৃত সৌন্দর্য তখনই ফুটে ওঠে, যখন তার প্রতিটি মানুষ সজাগ থাকে, সচেতন থাকে এবং নিজের ভূমিকাকে সম্মান করে। এই চেতনা জাগ্রত হলে তবেই আমরা একটি সভ্য, মানবিক এবং সমন্বিত সমাজ গড়ে তুলতে পারব- যেখানে মানুষে মানুষে পার্থক্য থাকবে, তবে বৈষম্য থাকবে না, স্বাধীনতা থাকবে, তবে দায়িত্বহীনতা নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত