ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মহাসড়কে ছোট দানব! তাহাকে রোধিবে কোন মানব

মো. তাহমিদ রহমান
মহাসড়কে ছোট দানব! তাহাকে রোধিবে কোন মানব

ব্যস্ত নগরীর স্তব্ধ দুপুরে যে রিকশার টুংটাং আওয়াজ একসময় মনের ক্লান্তি দূর করে দিত সেই রিকশাই আজকে যেন শহরবাসীর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই প্রকৃতিপ্রেমি যে হঠাৎ বৃষ্টিতে হুড নামানো রিকশায় মন্থর গতিতে ভিজতে ভালোবাসতো সেও যেন আজ বিরক্ত প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগানো এই রিকশায়! রিকশা আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। রাজধানী ঢাকার রিকশার বহুল ব্যবহার এবং নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী কাঠামোর কারণে ঢাকাকে বিশ্বের রিকশার রাজধানী বলে থাকেন অনেকে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে রিকশা ও রিকশাশিল্পকে বাংলাদেশের অস্পষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। রাজধানীতে রিকশা চলাচলের অনুমোদন দেয় সিটি কর্পোরেশন। এজন্য কর্পোরেশন থেকে রিকশার নিবন্ধন নিতে হয় এবং বছর বছর তা নবায়ন করতে হয়। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে সর্বশেষ রিকশার নিবন্ধন দিয়েছিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন। কর্পোরেশন সূত্র মোতাবেক দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা ৮০ হাজার ৪৭৩টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) চলে ৫২ হাজার ৭৫৩টি ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) ২৬ হাজার ৭২০টি। বিগত ৩৯ বছর কোনো নতুন রিকশার লাইসেন্স দেয়া না হলেও ঢাকায় চলে প্রায় ১০ লাখ ২০ হাজার রিকশা। অর্থাৎ ঢাকা শহরে চলা প্রায় ৮০ ভাগ রিকশাই অবৈধ। রাজধানী ঢাকায় চলা এই বিশাল সংখ্যক রিকশার অধিকাংশই ব্যাটারিচালিত। এবারের ঈদের আগে ও পরে ঢাকার রাজপথে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর তাণ্ডব স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার! দিনের তুলনায় রাতে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। আগে রাজধানীর অলি-গলিতে দাপিয়ে বেড়ালেও ইদানীং এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা শহরের মূল সড়ক এমনকি ফ্লাইওভারগুলোতেও চলাচল করতে শুরু করেছে। মূল সড়কের দুই পাশে পাল্লা দিয়ে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং হুটহাট উল্টোপথে ঢুকে পড়ছে। ফলশ্রুতিতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। আইনের তোয়াক্কা না করে সারা দেশেই মহাসড়কগুলোতে দিন দিন ভয়ংকর আকারে বেড়েই চলেছে ব্যাটারিচালিত রিকশা । প্যাডেলচালিত রিকশায় মোটর ও ব্যাটারি লাগিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলার কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। গত ২০ নভেম্বর, হাইকোর্ট সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে তিন দিনের মধ্যে ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। কিন্তু পরবর্তীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের চলমান আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচির মাঝেই সোমবার (২৫ নভেম্বর) এক মাসের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। এরপর ঢাকায় মূল সড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বেড়েছে হুঁ হুঁ করে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশায় দুর্ঘটনার সংখ্যাও বেড়েছে। ঈদের ছুটির চার দিনে দেশের ১০টি বড় সরকারি হাসপাতালে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের ৩২ দশমিক ১০ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশায় আহত হন। ব্যাটারিচালিত এসব রিকশার আরও একটি ভয়ংকর সমস্যা হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে রিকশার ব্যাটারি চার্জ দেয়া। একটি এলাকায় বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে তার অর্ধেকই টেনে নিচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জ দেয়ার মাধ্যমে। ফলে আবাসিক এলাকায় গ্রাহকরা ঠিকমতো বিদ্যুত পাচ্ছে না। জেলা শহরগুলোতে বিদ্যুৎ চুরির অন্যতম প্রধান কারণ নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। সারা দেশেই অবৈধ বৈদ্যুতিক লাইন থেকে এসব ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারি চার্জ দেয়া হচ্ছে প্রকাশ্যেই। এতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। আর লাভবান হচ্ছে অসাধু ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিকরা। শুধু রাজধানী ও এর আশপাশেই এ ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা কমপক্ষে ৮ লাখ। এসব যানবাহন চার্জ দিতে দৈনিক প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে ৫ থেকে ৬ ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারি চার্জ দেয়ায় প্রাত্যহিক জীবনে বিদ্যুতের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। ব্যাটারিচালিত রিকশাকে অনেকে দূষণরোধী, পরিবেশবন্ধু বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। যদিও ব্যাটারিচালিত রিকশা কোনো ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ করে না, কিন্তু এসব রিকশায় যে বিপুল পরিমাণ ব্যাটারি ব্যবহার করা হয় সেগুলো পুরোনো হয়ে গেলে যত্রতত্র ফেলে দেয়া হয় ফলে এসব ব্যাটারিতে থাকা সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়ামের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মাটির সঙ্গে মিশে যায়। সিসা, পারদ এবং ক্যাডমিয়াম মাটিতে জমা হয়ে মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং কৃষিজমির উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এগুলো সরাসরি সংস্পর্শে এলে বা দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি এবং লিভারের কার্যক্রমে বিপর্যয় ঘটাতে পারে। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীরা এই বিষাক্ত উপাদানের প্রভাবে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকে, কারণ এটি শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মূল সড়ক ও অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়ানো এসব ব্যাটারিচালিত রিকশায় ব্যবহৃত হচ্ছে হাইড্রোলিক হর্ন। বেশিরভাগ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকের প্রশিক্ষণ নেই। তারা সড়কে অহেতুক হর্ন বাজান। এতে মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে শব্দদূষণ। ব্যাটারিচালিত এ ধরনের রিকশার হর্নের লেভেল ৭০-৯০ ডেসিবেল হয়, যা ব্যক্তিগত গাড়ির হর্ন থেকেও প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি শব্দ উৎপন্ন করে। যা শ্রবণেন্দ্রিয়ের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সম্প্রতি রাজধানীর নির্দিষ্ট সড়কে প্যাডেল ও ব্যাটারিচালিত উভয় ধরনের রিকশার অনিয়ন্ত্রিত চলাচল নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগের অংশ হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে ট্র্যাপার বসানো হয় কিন্তু এই ট্র্যাপার ব্যাটারিচালিত রিকশা ঠেকাতে পারছে না। বরঞ্চ প্রধান সড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা মহানগর পুলিশের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলায় মেতে উঠেছে। যেহেতু সড়ক, মহাসড়কে দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশা একসঙ্গে চললে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তাই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ব্যবহার একেবারে বন্ধ করা না গেলেও একে অলিগলিতে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, প্রধান সড়কে উঠতে দেয়া যাবে না। এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ না করে লাইসেন্স ও রুট পারমিট দিয়ে নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের ন্যূনতম ১ মাসের সড়ক আইন-কানুন, ট্রাফিক চিহ্ন, সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে বাধ্যতামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণ সমাপ্তকারীদের নামমাত্র ফি নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে। হুট করে প্রশিক্ষণহীন কোনো ব্যক্তি যাতে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাটারিচালিত হলেও আপন স্বকীয়তায় নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও জনবান্ধন হয়ে টিকে থাকুক ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রিকশা পরিবহন ব্যবস্থা।

লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি), নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত