শিক্ষায় বিভিন্ন স্তর থেকে ছাত্রছাত্রীর ঝরে যাওয়া আমাদের দেশের টেকসই শিক্ষার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অতীতের সব সরকারই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, ঝরেপড়া কমেছেও তবে এখনও ঝরে যাওয়া ঠেকানো যায়নি। বরং বিপরীতে কিছুটা আশঙ্কাই থেকে যাচ্ছে। শিক্ষার মান এবং শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি যদি ঠিকঠাক না হয় তাহলে দেশ সবার আগে পেছনে পড়বে এটাই ভবিতব্য। যেমন এবারের শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী কমেছে। এবার পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে মোট ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন পরীক্ষার্থী। গত বছরের তুলনায় এবার পরীক্ষার্থী কমেছে প্রায় এক লাখ। শুধু তা-ই নয়, বিগত পাঁচ বছরে এবারই সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। জানা গেছে, ২০২৪ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন। ২০২৩ সালে ছিল ২০ লাখ ৭২ হাজার ১৬৩ জন, ২০২২ সালে ছিল ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন এবং ২০২১ সালে ছিল ২২ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৫ জন শিক্ষার্থী এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এখন প্রশ্ন হলো এত বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী কম কেন? যদি শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই এই সংখ্যা কম থাকত তাহলে এক রকম। আর শিক্ষাস্তরের বিভিন্ন পর্যায়ে যখন ঝরে যাওয়ার পর এই সংখ্যক টিকে থাকে সেটা অন্যরকম। কারণ এসএসসি পরীক্ষার পর এই সংখ্যা ঠিক থাকবে না। আরও কমবে। তার বিভিন্ন কারণও রয়েছে। কারণ গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, দেশে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে গত সাত বছরে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী কমেছে। পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে ২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ইবতেদায়ি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল ২৮ লাখ ২ হাজার ৭১৫ জন শিক্ষার্থী। স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারলে তাদেরই গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। তবে গত বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সারা দেশে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সাত বছরের শ্রেণি কার্যক্রমে প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষার স্বাভাবিক পথ থেকে ছিটকে পড়েছে। গড়ে প্রতি বছর ২ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। একবার ভাবুন, দেশে দুই লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে, মানে শিক্ষার্থীর একটি বিশাল অংশ। এখন এই সংখ্যক শিক্ষার্থীকে বাদ রেখে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা অর্জন এবং দেশ গঠন কখনওই অর্জন করা সম্ভব হবে না। শিক্ষার জন্য পরিকল্পনা থাকলেও একটি চেইন অব কমান্ড যা শিক্ষাকে একই সরলরেখায় প্রবাহিত করবে সেটির অভাব রয়েছে। শিক্ষা খাতে দরকার বিপুল সংস্কার। সবার জন্য শিক্ষা- এটাই শিক্ষার মূলমন্ত্র। দেশের প্রতিটি নাগরিক সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উন্নত বাংলাদেশ গঠনে অংশ নিবে। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটালাইজেশন অর্থাৎ চতুর্থ প্রজন্মের শিক্ষা। গুণগত শিক্ষার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ঝরে পড়া রোধ করা। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিকুলতা এবং সচেতনতার অভাবে শিক্ষাস্তরের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ার কয়েকটি স্তর রয়েছে। প্রাথমিক শেষে, এসএসসি শেষে এবং এইচএসসি শেষে বহু শিক্ষার্থী ঝরে যায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে তারা বাল্যবিয়ের শিকার হয় এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে কোনো শ্রমমূলক কাজে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। শিক্ষায় টেকসই অর্জনের লক্ষ্যে এটি একটি প্রথম শ্রেণির বাধা। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করার উদ্দেশ্য হলো কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষাকে আরও যুযোগপযুগী করে তোলা। শিক্ষার এই লক্ষ্য অর্জনে সরকার বহুবিধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এসব বহুবিধ উদ্দেশ্যের মধ্য অন্যতম হলো শিক্ষায় টেকসই উন্নয়ন সাধন বা মানসম্মত শিক্ষা প্রণয়ন করা। যেখানে শিক্ষার্থীর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়া হ্রাস করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘদিনের পদক্ষেপ। ঝরে পড়া আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই সমস্যা ক্রমহ্রাস করার চেষ্টাও দীর্ঘদিনের। কেন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে বা কেন হঠাৎ বিদ্যালয়ে আসা ছেড়ে দেয় তার বেশকিছু কারণ রয়েছে। যার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে দারিদ্র্যতা। অবশ্যই এটি কেবল আমাদের দেশের সমস্যা নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অনেকে দেশেই এই সমস্যা রয়েছে। দারিদ্র্যতা উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যা দূর হওয়ার কথা। মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যতার সঙ্গে আরও একটি সমস্যা হলো বাল্যবিয়ে। পাবলিক পরীক্ষায় যেসব মেয়ে শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে তাদের একটি বড় অংশের অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধান করলে বাল্যবিয়ে কারণ হিসেবে দেখা যাবে। এই সমস্যার সঙ্গে বহু আগে থেকেই সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। তবুও এটি ঘটেই চলেছে। একই সময় ছেলে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে অনেককেই বিভিন্ন শ্রমমূলক কাজে দেখা যাবে। বিভিন্ন গবেষণায় ঝরে পড়ার পেছনে যে কারণটি সবচেয়ে জোরালোভাবে উঠে এসেছে তা হলো পরিবারের আর্থিক অনটন। ছেলেদের ক্ষেত্রে কোনো কাজ শেখা বা কাজ করা এবং মেয়েদের বিয়ে দেয়ার ব্যস্ততা দরিদ্র পরিবারগুলোতেই বেশি দেখা যায়। আবার ভ্রান্ত ধারণাও এখানেই বীজ বপন করে। সর্বোপরি শিক্ষার প্রয়োজন আছে কি নেই সেই চিন্তা গভীরভাবে নেয়ার আগেই বা সন্তানের মতামত জানার আগেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
শিক্ষায় বাধা হিসেবে কাজ করছে ঝরে পড়া। ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এগুলো হলো- পরিবারের অন্যত্র চলে যাওয়া, বই-খাতাসহ লেখাপড়ার উপকরণ নষ্ট হয়ে যাওয়া, তাৎক্ষণিকভাবে স্কুলের ব্যয় বহনে অক্ষমতা, বাবা-মাকে ঘরের কাজে সহায়তা করা, উপার্জনে বা ভাগ্যান্বেষণে নেমে পড়া, লেখাপড়ায় আগ্রহ না পাওয়া, স্কুলে যেতে নিরাপদ বোধ না করা, যাতায়াতে যানবাহন সংকট সমস্যা ইত্যাদি। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, পড়ালেখার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এদের কেউ কেউ শিক্ষা জীবনে প্রবেশ করলেও বস্তুত বড় অংশই চলে যাবে কর্মজীবনে। কারণ তাদের বয়সটা এরকমই। এসব শিক্ষার্থীরা কিন্তু অনেক হাসি মুখে একদিন এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল আনতে গিয়েছিল, ভালো ফল করায় গর্বে বুকটা ফুটে উঠেছিল। সেই তারা এখন তার বন্ধুদের পড়তে দেখবে এবং নিজেরা সমাজে শ্রমের স্রোতধারায় চলে যাবে। অথচ উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন তারাও দেখেছিল। কেন তারা লেখাপড়ায় ফিরল না সেই কারণগুলো খুঁজে বের করা জরুরি। অনেক পরিবারই তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে এবং এক্ষেত্রে তাদের সদিচ্ছারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭ দশকি ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০১৭ সালে ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২০ দশমিক ৯ শতাংশ। এই পাঁচ বছরের হিসেবে ঝরে পড়ার হারে খুব বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। অথচ এই সময়ে শিক্ষায় বহু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফলে এই হার আরও কমা প্রয়োজন ছিল। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এই হার কমাতেই হবে। মাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৩৭ দশমিক ৮১ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৩৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৪০ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৪১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। প্রাথমিকের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী প্রতি মাসে এই উপবৃত্তি পাচ্ছে যা তার লেখাপড়াকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে। এটা শিক্ষার্থীর এবং তার অভিভাবকের বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তবুও ঝরে পড়ার হার হ্রাসে অগ্রগতি গত পাঁচ বছরে সামান্যই। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত না করতে পারলে ঝরে পড়ার হারও কমিয়ে আনা সম্ভবপর হবে না। অন্যসব কারণের সঙ্গে আনন্দহীন শিক্ষাব্যবস্থাও ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে খানিকটা দায়ী। মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন আনন্দপূর্ণ পাঠদান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান আনন্দপূর্ণ করার নানা কৌশল প্রণীত হয়েছে। ঝরেপড়া রোধে শিক্ষার পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে। এটি একটি বড় সাফল্য। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতাও নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু এদের ধরে রাখতে হবে এবং উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এই শিক্ষা হবে মানসম্মত শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষাই পারে টেকসই উন্নয়নের গতি বেগবান করতে। আমরা আশা করতে পারি মিড ডে মিল কার্যক্রম প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার আরও অনেক কমিয়ে আনবে। শিক্ষার্থীদের যে উন্নতমানের খাবার দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে শিখনে মনোযোগ ফেরাতেও সাহায্য করবে। সেইসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও ঝরেপড়া হ্রাস পাবে এবং সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে। একটি শিক্ষিত ও সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে অনুসরণীয় একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে তা শিক্ষা ক্ষেত্রেও নিয়ে আসবে পরিবর্তন এ প্রত্যাশাই করি।
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট পাবনা।