‘বাংলা নববর্ষ’ বাংলা নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে বাঙালিরা পালন করে থাকে যা বাঙালির একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এটি বাঙালি জাতীয়তা বোধের একটি অংশ। জীর্ণ-পুরোনোকে মুছে দিয়ে সম্ভাবনার আরেকটি নতুন বছরে পা রাখে বাঙালি জাতি। পহেলা বৈশাখ শুধু একটি তারিখ নয়, বাঙালির জীবনে এটি একটি নবআশার সঞ্চায়ক।
বাঙালির ব্যস্তময় নাগরিক জীবনের সাথে লোকজের একটি মেলবন্ধন তৈরি করে পহেলা বৈশাখ। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে শুধু বাঙালিই নয়, বাংলা ভাষাভাষী আদিবাসী ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীও নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়।
অতীতে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ‘ঋতুধর্মী উৎসব’ হিসেবে পালিত হতো যার মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। যদিও বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে এটির প্রবর্তন শুরু হয়, তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কালের পরিক্রমায় এটি এখন বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন স্থানে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আয়োজিত একটি নতুন বর্ষবরণ উৎসব। বাংলাদেশে এই উৎসবটি একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের প্রতীক।
পহেলা বৈশাখ একটি সর্বজনীন উৎসব এই কারণে যে এই উৎসবে সকল ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করে। বাঙালি জাতির আবহমানকাল থেকে মৌলচেতনা অসাম্প্রদায়িকতা চর্চা।
এখানে সবাই যার যার মতো করে জীবনকে যাপন করতে পারে। নিজস্ব রীতিনীতি-কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ধর্মানুযায়ী আচার ও ধর্ম পালন করতে পারে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল অথবা ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে ১৪ এপ্রিল দিনটিকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। এমনকি এই দিন উপলক্ষে সরকার বাংলাদেশের চাকরিজীবীদের জন্য ঈদ-পূজার বোনাসের মতো ‘বৈশাখী ভাতা’ চালু করেছে।
বাংলা নববর্ষের সৃষ্টির ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে রাজা-বাদশাহদের প্রাসাদে, নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, নতুন বঙ্গাব্দর জন্ম মোগল বাদশাহ আকবরের দরবারে। বাংলা নববর্ষ সম্রাট আকবরের সময় থেকে পালন করা হত। ভারতবর্ষে খাজনা আদায় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৫৬ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা তথা ফসলি সন প্রবর্তন করেন। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। এদেশে প্রচলিত হিজরি সালের সাথে মিল রেখে শুরুর সালটি ছিল ৯৬৩ সাল। ওই সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করত। তখন নববর্ষ ‘আর্তব উৎসব’ বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। কারণ তখন কৃষিকাজ ছিল বিশেষ ঋতুনির্ভর। ফসল বোনা, পরিচর্যা ও কাটাসহ যাবতীয় কাজ বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী করা হতো। ফসল ছাড়াও কৃষিনির্ভর সমাজের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সব কাজেই বাংলা সনের একক ব্যবহার ছিল। ইংরেজি দিন-রাত ১২টায় এবং হিজরি দিন সন্ধ্যায় শুরু হলেও বাংলা সনের দিন শুরু হয় ভোরে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা যেহেতু পান্তা খেয়ে মাঠে যেতেন, সেখান থেকেই প্রচলন হয় পান্তা ও কাচমরিচের।
বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা তোলা শেষে পহেলা বৈশাখে ভূমিস্বামীরা নিজ এলাকার অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যা আজো পালিত হয়। তখনকার সময় এই দিনে হালখাতা নামক একটি নতুন হিসাব বই খোলা হতো যা এখনো প্রচলিত রয়েছে। এখনো হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এখনো পহেলা বৈশাখের দিন ধানের বীজ ছড়িয়ে কৃষক বাড়ির লেপানো উঠানে রেখে দেয়া হয় কচি আম পাতা, দুর্বাঘাস, আরও নানাকিছুসহ পানি। হালের গরুকে গোসল করানো হয়। বাড়িতে আলাদা করে রান্নার আয়োজন থাকে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে, সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সনের পূর্বে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি, তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।
১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। এদিন সূর্যোদয়ের পর পর ছায়ানটের বটমূলে শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ইউনেস্কো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদায় ভূষিত করে যা আমাদের করেছে জাতি হিসেবে গৌরবান্বিত।
নববর্ষের উৎসবের সঙ্গে রয়েছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। এখন দেশ ও দেশের বাইরে অনেক জায়গায় বাঙালিদের জন্য নববর্ষের দিন বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। মেলায় প্রাণের জাগরণ ঘটায় নাগরদোলার মতো নানা আয়োজনের উপস্থিতি, হাটে মাঠে ঘাটে জারি সারি ভাটিয়ালি গানের ঢেউ ওঠে। মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, সাপের খেলা, চরকি ওড়ানো, ঘুড়ির কাটা প্রতিযোগিতা, নানা রংয়ের পুতুল নাচের আয়োজনও থাকে হরহামেশা। বাঁশি বিক্রেতা বাঁশি বাজিয়ে মুখর করে তোলে মেলা প্রাঙ্গণ। এই উৎসবকে ঘিরে যাত্রাপালার আয়োজনও করা হয়। এছাড়া পহেলা বৈশাখ সোনারগাঁওয়ে ১০০ বছর ধরে ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে যার নাম বউমেলা যা স্থানীয়ভাবে ‘বটতলার মেলা’ নামে পরিচিত। সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজোর জন্য এখানে সমবেত হয় সনাতন ধর্মাবলম্বী কুমারী, নববধূ ও জননীরা তাদের মনস্কামনা পূরণের আশায়। এখানে আরেকটি প্রচলিত মেলার নাম ঘোড়ামেলা।
এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। বাংলা নববর্ষের একটি পুরোনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি একসময় প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে, যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরাও নিজেদের মতো করে নিজেদের স্বাজাত্যবোধ বজায় রেখে এই উৎসবের রঙ ছড়ান।
তারা অন্যান্য উৎসবে নিজেদের মধ্যে বৃত্তবন্দি থাকলেও পহেলা বৈশাখের উৎসবে মিশে যান একাত্মবোধে। বিদায়ী বর্ষের চৈত্রসংক্রান্তির দিন এবং নতুন বর্ষের প্রথম দিনকে ঘিরে পার্বত্য জেলাসমূহে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব??? ‘বৈসাবি’ উদযাপিত হয়। বাঙালির গণমাধ্যমেও বৈশাখ, নববর্ষ, চৈত্রসংক্রান্ত্রি, বিদায়ী বর্ষকে ঘিরে নানা আয়োজন থাকে। শুধুমাত্র বিনোদন কিংবা ফিচার বা লাইফস্টাইলের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বুদ্ধিবৃত্তি ও সৃজন-মননশীল দৃষ্টিকোণ থেকেও এর গুরুত্ব উপস্থাপন করা হয়।
একটা উৎসব কীভাবে সর্বজনীন হয়ে ওঠে, কীভাবে প্রসার ও প্রচার ঘটে, তার দৃষ্টান্ত বাঙ্গালির পহেলা বৈশাখ। যদিও আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি ও বাংলা সন এখন একাধিপত্য করতে পারছে না, তবুও বাংলা সন কিংবা বঙ্গাব্দ বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং জাতীয় সংস্কৃতিতে এর প্রভাব এখনো অনস্বীকার্য। সব জাতিই নিজ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বর্ষবরণ পালন করে থাকে।
বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সকল বিভাগ, জেলা, উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়ে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের আয়োজন করা হয়। বর্ষবরনকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজনে আমরা উন্মুখ হয়ে থাকলেও যাদের কেন্দ্র করে এই উৎসবের আয়োজন, আমরা ক’জন সেই কৃষকের খবর রাখি? শ্রমে-ঘামে-মেহনতে যাদের সূর্যোদয়টি সত্যিই পান্তা আর মরিচ দিয়ে শুরু হয়, আমরা কি পারি না, তাদের জন্য দুবেলা দু-মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা দিতে? নববর্ষ ১৪৩২ সনে আমরা প্রত্যাশা করি দেশ ও জাতির মঙ্গল, একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, একটি যুদ্ধ-ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।
শিক্ষক ও গবেষক বরগুনা, বাংলাদেশ