ঢাকা সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ৮ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঢাকা শহরে আমরা কীভাবে বেঁচে আছি?

আবুল খায়ের বাবু
ঢাকা শহরে আমরা কীভাবে বেঁচে আছি?

লেখাটা যখন লিখতে বসেছি, তখন বিশ্বে অস্বাস্থ্যকর দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় ১২তম স্থানে ঢাকার অবস্থান। ঢাকায় বসবাস একেবারেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। শহরটি তার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ আর সহ্য করতে পারছে না।

অতিরিক্ত জনসংখ্যা, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণসহ মানবিক জীবনযাপনের অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ের নানা সমস্যা আছে। সেই সাথে আমরা রাজনৈতিক জনসভা করছি, যে কোন ইস্যু নিয়ে যখন-তখন দাবি আদায়ের জন্য অতি ব্যস্ততম সড়ক অবরোধ করছি। যানযটে জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলছি। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার কোনো উপায় নেই, হয় তা ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়, না হয় নির্মাণাধীন অট্টালিকার নির্মাণসামগ্রীর গোডাউন, না হয় বেচা-বিক্রির পসরা সাজিয়ে বসেছেন ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। সড়কগুলোতে বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের একজন খোঁড়াখুঁড়ি করে গেলে আর একজন এসে মেরামত শেষ করে। তারা যেতে না যেতেই আর একজন খুঁড়তে শুরু করে এভাবেই খানাখন্দ থাকছে সব সময়।

এলাকার সুউচ্চ অট্টালিকা তৈরিতে বিল্ডিং কোড কেউ মানতে চাই না, চারিদিকে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত জায়গা না রেখে এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে, উপর থেকে কেউ থুথু ফেললেও তা পথচারীদের মাথায় এসে পড়ছে। কোনো দুঘর্টনায় অগ্নিনির্বাপণ কর্মীদের উদ্ধার কাজের গাড়ি ঢোকার সম্ভাবনা নেই। অতি ঘনঘন ভূমিকম্প আক্রান্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। আল্লাহ না করুক, কোনো অঘটন ঢাকায় ঘটলে উদ্ধারকাজ চালানোর কোনো সুযোগ হবে বলে মনে হয় না।

গত কয়েক মাস ধরে, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঢাকার বাইরে ভ্রমণ করতে হয়েছে। গ্রামে থাকাকালীন আমি যে স্বস্তি অনুভব করেছি তা অনস্বীকার্য। ঢাকার অস্বাস্থ্যকর অস্বস্তিকর পরিবেশের চেয়ে সেখানকার সতেজ বাতাস এবং শান্ত পরিবেশ অনেক বেশি আরামদায়ক। গ্রামের নলকূপের পানির স্বাদ এবং স্বচ্ছতা অসাধারণ, এমনকি বোতলজাত মিনারেল পানির থেকে অনেক ভালো। ঢাকা থেকে গ্রামে যাওয়ার পথে লক্ষ্য করেছি যে, কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত বাতাস সম্পূর্ণ দূষিত, ধুলাবালি এবং দুর্গন্ধে ভরা। যতই সামনে এগোতে থাকি স্বস্তি অনুভূত হতে থাকে। মেঘনা সেতু পার হওয়ার সাথে সাথে চারিদিকের আবহাওয়া বেশ সতেজ অনুভূত হয়।

ঢাকা শহরের অস্বাস্থ্যকর বাতাসের যেন সম্পূর্ণ বিপরীত এক উপলব্ধি। আসা যাওয়ার সময় বারবার মনে প্রশ্ন জাগে, মানব জীবনের জন্য একেবারই অনুপযুক্ত পরিবেশে ঢাকা শহরে আমরা কীভাবে বেঁচে আছি? ক্রমাবনতিশীল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আর কতদিন আমরা এভাবে বাঁচতে পারব? নতুন প্রজন্মের জন্য আমরা কেমন ঢাকা রেখে যাচ্ছি। আমার তো মনে হয় যাদের প্রকৃত ঢাকা শহরে কোনো কাজই নেই, বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে তাদের এই শহরের বসবাসকারী কর্মজীবী মানুষকে অতি জনসংখ্যার চাপ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে বাঁচাতে, পরিবেশবান্ধব শহর গড়তে ঢাকা ত্যাগ করার কথা এখনই ভাবা দরকার।

আল্লাহর রহমত ছাড়া আমরা কেউই এক মুহূর্তেও বাঁচতে পারব না। তবে ঢাকায় বসবাসকারী আমরা মনে হয় আল্লাহর অতি স্পেশাল রহমতেই বেঁচে আছি। প্রতি মুহূর্তে আমরা যে খাবার খাচ্ছি- তাতে ফরমালিন, কার্বাইড এবং অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিকের উপস্থিতি, রাস্তার পাশে উন্মুক্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার বিক্রি হচ্ছে আমরা নির্দ্ধিধায় খাচ্ছি। আমরা প্রাণ বাঁচাতে যে শ্বাস নিচ্ছি, সেই বাতাস ধুলাবালি শিশা, মিথানল-গ্যাসসহ নানা প্রকার ক্ষতিকারক পদার্থে পূর্ণ। এমনকি আমরা যে পানি পান করছি, যা জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, সেটাও ময়লা, দুর্গন্ধ এবং জীবাণু পোকাণ্ডমাকড়ে ভরা। ফলে ফুটন্ত সেই পানি পান করাটাও প্রায় অনেক এলাকায় অসম্ভব হয়ে যায়। ওয়াসাকে বললে সোজা জবাব দেবে তাদের সরবরাহকৃত পানিতে সমস্যা নেই, গ্রাহকের ট্যাঙ্ক অপরিষ্কার। কিন্তু গ্রাহক তাদের ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করে ভালো পানি পান না তা তাদের বোঝানো সম্ভব না। আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি তা দূষিত, আছে সীসা, কার্বন এবং অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থে ভরা।

মেয়াদোত্তীর্ণ বা নকল ওষুধ খাচ্ছি, ডাক্তারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সুচিকিৎসা পাচ্ছি না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সরকারি হাসপাতালগুলো নিজেরাই অসুস্থ-রুগ্ন অতি নিম্নমানের চিকিৎসার সাথে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সুস্থ মানুষ ও বোধ করি অসুস্থ হয়ে যায়। সিটি কর্পোরেশন হওয়ায় বাড়তি ট্যাক্স দিচ্ছি; কিন্তু প্রাপ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

অনেকবারই দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিকেন্দ্রীকরণ করে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে স্থানান্তর করার চেষ্টা চলেছিল আবার কোনো একসময় তা থেমেও গেছে। যে দেশে এলাকার সংসদরাই নিজ এলাকায় থাকেন না, মন্ত্রী-আমলারা কীভাবে রাজধানী ছেড়ে থাকবেন? রাজধানী ঢাকায় বসবাস করা গর্বের বিষয় বৈকি? দৃষ্টিনন্দন ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল এবং উড়াল সড়ক-এর মতো মেগা-প্রকল্পগুলো দেখে মুগ্ধ হই প্রাণ জুড়ায়। হঠাৎ ঢাকায় এসে মানুষ সেই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করে আপ্লুত হয়। মাত্র কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতে আমাদের সেই চোখ জুড়ানো মন ভুলানো ঢাকা শহরের রাস্তায় চলাচল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। রাস্তাঘাট এতটাই জলমগ্ন হয়ে যায় যে, একেবারে নোংরা কালো কুচকুচে পানিতে ভরা বুড়িগঙ্গা নদী এবং শহরের রাস্তা-ঘাটের মধ্যে কোনো পার্থক্য বোঝার উপায় থাকে না। শহরের অবকাঠামো আপাতদৃষ্টিতে চিত্তাকর্ষক মনে হলেও বাস্তবে ঢাকায় বসবাসকারীদের জীবন খুব সুখকর কি?

আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে নগরবাসীর কল্যাণে শহরের উন্নয়নের জন্য বিশাল বিশাল পরিকল্পনার কথা শুনি। দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো উন্নতির সাথে সাথে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোয় চোখ জুড়ানো মনের মতো যতই সুন্দর শহর হোক না কেন, যদি তার অধিবাসী সুস্থ না থাকতে পারে, তবে নয়ন জুড়ানো প্রকল্প মানুষের জন্য সুখ বয়ে আনতে পারে না। মাঝে মাঝে বিভিন্ন মিডিয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যখন বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করেন, তখন আমার কেন যেন একটা পুরোনো নাটকের দৃশ্য চোখে ভাসে- যদিও কথাগুলো সঠিক মনে নেই। সেখানে অভিনেত্রীকে তার সহ-অভিনেতা রাতে ঘরের দরজা আটকিয়ে ঘুমাতে পরামর্শ দিলে জবাবে অভিনেত্রী বলেন, ‘ঘরের যেখানে কোনো বেড়াই নেই, সেখানে দরজা বন্ধ করে দেয়ায় কী লাভ?’

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অতিপ্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়ের সাথে প্রয়োজন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দূষণমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ। দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সুস্থ-সবল সুশিক্ষিত জনবল। শুধুমাত্র দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, সুস্থ সবল সুশিক্ষিত নাগরিকের প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের বড় দায়িত্ব। আসুন আমরাও দায়িত্ববান নাগরিক হিসাবে আমাদের চারপাশ পরিষ্কার রাখি। সরকারের সাথে সাথে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরিতে সামর্থ্য অনুযায়ী নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে আসি। নতুবা এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই বসবাসের অযোগ্য ঢাকা শহরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত