ইংরেজরা শাসনক্ষমতা দখল করার পূর্বে এই অঞ্চলে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল তাকে দেশীয় শিক্ষা বলা হয়। আটচালা, গুরুগৃহ, মসজিদ, অবস্থাশালীর বৈঠকখানাকেন্দ্রীক এই শিক্ষাব্যবস্থা ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত হত। এই শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অনেকটা ধর্মকেন্দ্রীক। মুসলমানদের জন্য ছিল মক্তব ও মাদ্রাসা, হিন্দুদের জন্য ছিল টোল ও পাঠশালা বা বিদ্যালয়। ১৮১৩ সালের পূর্বে ইংরেজরা এই দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানি সনদ আইনে ইংরেজরা দেশীয় শিক্ষার উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে এক লাখ টাকা বরাদ্দ করেছিল।
কিন্তু এই টাকা কীভাবে ব্যয় হবে তা নিয়ে দেখা দেয় বিতর্ক। সর্বশেষ এই টাকা ব্যয়ের জন্য টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলে এর নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এই নীতিতে লর্ড মেকেলে বলেন, সমাজের কিছু লোককে শিক্ষিত করে তোলা হবে। এই সব শিক্ষিত লোক হতে চুইয়ে পালাক্রমে অন্যরা শিক্ষিত হবে। এই শিক্ষিত লোকগুলো কোম্পানির শাসন পরিচালনায় দোভাষীর কাজ করবে এবং এরা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়; কিন্তু পছন্দে ও রুচিতে হবে ইংরেজ।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইংরেজরা ১৯০ বছর শাসন করে বিদায় হল, পাকিস্তানিরা শাসন করল ২৩ বছর, স্বাধীনতার ৫৩ বছরও পার হল; কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা লর্ড মেকেলের দোভাষী তৈরির পরিকল্পনা পরিবর্তন হয়ে হতে পেরেছে বড় জোর কেরানি তৈরির ব্যবস্থা। চলমান শিক্ষাব্যবস্থা হতে প্রতিবছর লাখ লাখ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী বের হচ্ছে; কিন্তু তারা কোথায় কী কাজ করবে তার নির্দিষ্ট গন্তব্য কারোই জানা নেই। ফলে যুব সমাজ উদ্দেশ্যবিহীন পড়ালেখা করে। গোদের উপর বিষের ফোড়া হিসেবে কাজ করছে ইংরেজদের রেখে যাওয়া শাসন কাঠামো আঁকড়ে থাকা। এই কাঠামো অনুযায়ী এডমিন ক্যাডার নামক গোষ্ঠী শাসন ক্ষমতার মহাপরাক্রমশালী অবতার। এই অবতার হওয়ার জন্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সবাই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে। ফলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। সব মিলিয়ে শিক্ষাজীবন শেষে একদল হতাশাগ্রস্ত যুবকের হাপিত্যেশ দেখতে হয় জাতিকে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২-এর কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে ২০১০ সালে প্রফেসর কবির চৌধুরীর জাতীয় শিক্ষা নীতি, মাঝখানে আরো কত শিক্ষা কমিশন হলো; কিন্তু জাতি এখনো যুগোপযোগী ও সমাজব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা পায়নি। মাঝখানে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে তৎকালীন সরকার দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম নামে সনদধারী মূর্খ তৈরির একটা প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। সৌভাগ্যক্রমে ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদ পতনের সাথে সাথে তাদের শিক্ষাক্রমেরও পতন হয়েছে।
ড. ইউনূস সরকার এরই মধ্যে রাষ্ট্রে বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণ, পছন্দ, অপছন্দ, সততা, অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই বলা যায়, গলদপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা বজায় রেখে অন্যখাতগুলো সংস্কার করেও লাভের লাভ কিছুই হবে না। আমি মনে করি, এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাবত তাবত পণ্ডিতবর্গের সাথে অজপাড়াগাঁয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, অন্যথায় অজপাড়াগাঁয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সক্ষমতা ও প্রয়োজন বিবেচনার বাইরে থেকে যাবে।
শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কয়েকটি প্রস্তাবনা উল্লেখ করা হলো : ১. শিক্ষাব্যবস্থায় থাকবে তিনটি স্তর। স্তরগুলো হলো- প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা।
প্রাথমিক স্তর : প্রাথমিক শিক্ষায় থাকবে তিনটি উপস্তর। স্তরগুলো হলো- প্রাক-প্রাথমিক, নিম্ন প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক। ১ বছর মেয়াদি হবে প্রাক-প্রাথমিক স্তর। প্রথমশ্রেণি হতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নিম্ন প্রাথমিক স্তর হিসেবে থাকবে। বিদ্যমান প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো প্রাক-প্রাথমিক ও নিম্ন প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ষষ্ঠ শ্রেণি হতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উচ্চ প্রাথমিক স্তরের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বিদ্যমান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো উচ্চ প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ক্রার্যক্রম পরিচালনা করবে। বর্তমানে যে সকল বিষয় পড়ানো হচ্ছে, তা চলমান থাকবে। ধর্ম শিক্ষা বিষয়ের বিষয়বস্তু এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যেন প্রত্যেক শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণি সম্পন্ন করার সাথে সাথে নিজ ধর্মগ্রন্থ পঠন ও নিজ ধর্মের আচার ও রীতিনীতি পালন করতে সক্ষম হয়। বিদ্যমান প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে একই ধর্মের ৩০ জন শিক্ষার্থী থাকলে ওই ধর্মের একজন ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ে পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিষয়বস্তু এমন হবে যে, একজন শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করলে পৌরনীতি, ইতিহাস, ভূগোল ও অর্থনীতির মৌলিক জ্ঞানের অধিকারী হবে। এই মৌলিক জ্ঞান দ্বারা শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে সচেতন নাগরিকের গুণগুলো অর্জন করতে সক্ষম হবে। অষ্টম শ্রেণি শেষে শিক্ষার্থীর জন্য একটি পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা একটি সনদ লাভ করবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক।
মাধ্যমিক স্তর : মাধ্যমিক স্তরে থাকবে দুইটি উপস্তর। নিম্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক। নিম্ন মাধ্যমিকে থাকবে দুইটি শাখা। একটি কর্মমুখী শাখা অন্যটি সাধারণ শাখা। অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ মোট শিক্ষার্থীর অর্ধাংশ মেধার ভিত্তিতে সাধারণ শাখায় ভর্তির সুযোগ পাবে। যারা বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় দুই বছর মেয়াদি কোর্স সম্পন্ন করবে। অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ যারা সাধারণ শাখায় পড়ার সুযোগ পায়নি এবং যারা নিজেরা পছন্দ করবে, তারা কর্মমুখী শাখায় তিন বছর মেয়াদি কোর্স সম্পন্ন করার সুযোগ পাবে। এ শাখার শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে দেশ ও দেশের বাইরে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূর্ণ করবে। কর্মমুখী শাখায় শ্রম নির্ভর বিভিন্ন ট্রেড থাকবে। যেমন- ড্রাইভিং, প্লাম্বিং, ইলেকট্রেশিয়ান, নির্মাণশিল্প, টেইলারিং, বিউটি পার্লার, হাসপাতাল ওয়ার্ড বয়-গার্ল, অটো মোবাইল, রান্নাবিষয়ক, মোবাইল ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি সার্ভিসিং, সেলসম্যান, ওয়েল্ডিং এবং ওয়ার্কশপ, ক্লিনার, সেলুন বা চুলকাটা, জুতা তৈরি, নাবিক, কনফেকশনারি ইত্যাদি। ট্রেডগুলোর বিষয়বস্তু এমনভাবে নির্ধারণ করা হবে যে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষে দেশ ও দেশের বাইরে কাজ করতে সক্ষম হবে।
কর্মমুখী শিক্ষা শাখায় বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি অন্য আরো একটি বা দুইটি বিদেশি ভাষা শেখানো হবে, যাতে শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষার্থীরা বিদেশে কাজ পেতে পারে। বিদেশি ভাষার পাশাপাশি যে সকল দেশে আমাদের সম্ভাবনাময় শ্রম বাজার রয়েছে, ঐ সকল দেশের সাধারণ আইনকানুন ও রীতিনীতি শেখানো হবে। তিন বছর কর্মমুখী শিক্ষা শেষে বিভিন্ন কারখানায় ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে এক বছর মেয়াদি ইন্টার্নশিপ করবে। ইন্টার্নশিপ শেষে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হলে এরা কর্মজীবনে প্রবেশ করবে।
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে থাকবে দুইটি শাখা। একটি সাধারণ শাখা অন্যটি কারিগরি শাখা। নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অর্ধাংশ মেধাভিত্তিতে সাধারণ শাখায় বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে দুই বছর মেয়াদি কোর্স সম্পন্ন করার সুযোগ পাবে। অন্যরা তিন বছর মেয়াদি কারিগরি শাখায় ভর্তির সুযোগ পাবে। বিদ্যমান বিভিন্ন ডিপ্লোমা কোর্সগুলো এ শাখার অন্তর্ভুক্ত হবে। বিদ্যমান ট্রেডগুলোর পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বে চাহিদা আছে, এমন ট্রেড চালু করা হবে। কারিগরি শাখার শিক্ষার্থীদের বিদেশি ভাষা, আইনকানুন ও রীতিনীতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান প্রদান করা হবে, যাতে তারা বিদেশে কর্মসংস্থানের যোগ্য হতে পারে।
উচ্চ শিক্ষা : বিদ্যমান চিকিৎসা, প্রকৌশলী, আইন শিক্ষা চলমান থাকবে। এগুলোর পাশাপাশি চার বছর অনার্স কোর্স চালু থাকবে। উচ্চ শিক্ষা হবে সম্পূর্ণ গবেষণানির্ভর।
২. শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলে শ্রেণিকক্ষে কাজ শুরুর পূর্বে দুই মাসের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। প্রশিক্ষণে প্যাডাগোজি দিকের পাশাপাশি বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থী কর্তৃক সৃষ্ট বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাবলি কীভাবে একজন শিক্ষক নিয়ন্ত্রণ করবে তা আলোকপাত করা হবে। প্রশিক্ষণে দেশের সাধারণ আইনকানুন ও চাকরি বিধি সস্পর্কে অবগত করা হবে।
৩. শিক্ষকদের বেতন ভাতা কাঠামো এমন হবে যাতে একজন শিক্ষককে টিউশন, ইমামতি, বীমা কোম্পানি বা এমএলএম ব্যবসায় এর এজেন্ট, ওষুধের দোকান অর্থাৎ অন্য আরেকটি পেশার সাথে যুক্ত হতে না হয়।
৪. বিগত সময়ে বিভিন্ন কোটায় অসংখ্য শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের অনেকের মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। তাই কর্মরত সকল শিক্ষকের মান নিরূপণের জন্য একটি বিশেষ পরীক্ষার আয়োজন করা হবে। যারা কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পারবে না, তাদের অন্য কোনো বিভাগে আত্মীয়করণ বা অবসর প্রদান করা হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হবে যুগোপযোগী এবং কর্মমুখী।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, নদোনা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী।