দেশে শীর্ষ পর্যায়ের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিং’ ও ‘কোয়াকোয়ারেলি সাইমন্ড’স (কিউএস) র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এগুলো নেই। কেবল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৮০০ থকে ১০০০-এর মধ্যে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ব্র্যাক, নর্থ-সাউথ এবং ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং তুলনামূলক ভালো। এসব র্যাঙ্কিং শতভাগ সমালোচনার ঊর্ধ্বে না হলেও র্যাঙ্কিংগুলো আমাদের উচ্চশিক্ষার নাজুক পরিস্থিতি প্রকাশ করে নিঃসন্দেহে। এরূপ বাস্তবতায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম একটি আন্দোলন ও নানা ঘটনা প্রবাহের পর বিগত ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ঢাকাস্থ সাতটি বৃহৎ সরকারি কলেজকে নিয়ে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ বা ডিসিইউ নামে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। ঢাকার এই সাতটি সরকারি কলেজ হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বাংলা কলেজ, শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ।
এটি খুবই আশার কথা যে, শিক্ষার্থীরা মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার জন্য আন্দোলন করেছে। তাদের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির সংযোগ কতটা অর্থবহ হবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে নিকট অতীতের কিছু উদাহরণ ও বাস্তবতার নিরিখে বিষয়টি গঠনমূলক আলোচনার দাবি রাখে। একাত্তর পূর্ববর্তী বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র ছয়টি এবং কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন হয় ১৯৯৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসির তথ্য মতে বর্তমানে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৭টি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ১১৫টি।
২০০৫ সালে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ (২৮নং আইন) বলে একই বছর ২০ অক্টোবর ১৫০ বছরের পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি জগন্নাথ কলেজকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে আত্মপ্রকাশ করানো হয়।
বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একচল্লিশটি বিভাগ সাতটি অনুষদ ও দুইটি ইনস্টিটিউট রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় বিশ হাজার এবং শিক্ষক রয়েছেন সাতশ’রও অধিক। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন মামলা মোকাদ্দমা, আন্দোলন, জমি অধিগ্রহণের জটিলতার সম্মুখীন হয় প্রতিষ্ঠানটি। বিশ বছর অতিবাহিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনও গবেষণা, অবকাঠামো, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটসহ নানাবিদ সমস্যায় জর্জরিত। এত বছরেও ঢাকার কেরাণীগঞ্জের পশ্চিমদি মৌজায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণ সমাপ্ত হয়নি। অপরদিকে স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই বরিশাল অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল। ছাত্র-গণ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একজন রাষ্ট্রপতি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাসংকুল উদাহরণ ও বাস্তবতার নানা প্রেক্ষাপটে বরিশালের ছাত্র-শিক্ষক-জনতা বিএম কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি থেকে সরে এসে বরং নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনকে প্রাধান্য দেয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে বরিশাল জিলা স্কুলের পরিত্যক্ত কলেজ ভবনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হলেও তুলনামূলক কম সময়ের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন বর্তমানে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশে উপযুক্ত অবকাঠামোসহ ৬টি অনুষদের অধীন ২৫টি বিভাগে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে সগৌরবে অগ্রসরমান।
এটি প্রমাণিত সত্য যে, বেসরকারি স্কুল-কলেজকে আত্তীকরণের মাধ্যমে সরকারি স্কুল-কলেজে রূপান্তর করা কিংবা সরকারি কলেজকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার চেয়ে নতুন সরকারি স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা অধিকতর গুণগত মানের নিশ্চয়তা দেয়। কারণ পূর্ব হতে চলমান কোনো প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, নিয়োগ ও ভৌগোলিক অবস্থান ওই প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের স্তর বিবেচনা করে নির্ধারণ ও নির্মাণ করা হয়। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে রূপান্তরিত প্রতিষ্ঠানের জন্য যা অতটা বাস্তবসম্মত হয় না। আবার শুধু সনদপত্রে বিশ্বিবদ্যালয় শব্দটি যুক্ত থাকলেই সনদটির গুরুত্ব বা মূল্যায়ন বেড়ে যায় না। মোটা দাগে একটি উদাহরণ এরকম হতে পারে যে, ‘লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স’- যা সংক্ষেপে ‘লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স’ এর নামের শেষে বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি না থাকলেও এর সনদের গুরুত্ব পৃথিবীতে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। আবার বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়টি নির্দিষ্ট কোনো ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি ঊনচল্লিশটি কন্সটিটিউয়েন্ট কলেজ এবং ছয়টি পার্মানেন্ট প্রাইভেট হল বা পিপিএইচ এর সমন্বয়ে চলমান। অর্থাৎ নাম কিংবা ক্যাম্পাস কখনও শিক্ষার গুণগত মান ও সনদের গুরুত্ব বৃদ্ধি করে না।
অনেকেই বাংলাদেশে গুণগত শিক্ষার প্রধান অন্তরায় হিসেবে মানসম্মত শিক্ষকের অভাবকে ঢালাওভাবে দায়ী করছেন। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার অদক্ষতা, পাঠ্যক্রমের দুর্বলতা, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, গবেষণার দৈন্যদশা, অদক্ষ মূল্যায়ন পদ্ধতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো অন্তরালে থেকে যাচ্ছে। মানসম্পন্ন প্রশিক্ষিত শিক্ষক স্বল্পতা হয়তো রয়েছে এবং প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও এ সমস্যাটি উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক এবং চাইলেই এ সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব নয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষকতা করেন তাদের অধিকাংশই সন্দেহাতীতভাবে উচ্চ মানসম্পন্ন হলেও তাদের প্রত্যেকেই শতভাগ কাম্যমানে অবস্থান করছেন এমনটিও ভাবার সুযোগ নেই। অপরদিকে সাত কলেজে যারা কর্মরত আছেন তারা প্রত্যেকে বিসিএসের মতো একটি জটিল বৈতরণী পার হয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। তারাও প্রত্যেকেই নিঃসন্দেহে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তারা তাদের মেধা ও যোগ্যতা প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন খুবই সীমিত আকারে।
ডিসিইউ’র পরিচালনা পদ্ধতি কী হবে, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কারা হবেন, শিক্ষক কারা হবেন- কীভাবে হবেন এ প্রশ্নগুলো খুবই জরুরি এবং উত্তরগুলো খুব সহজ নয়। ক্যাম্পাস সাতটি হলেও এর প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে একজন প্রশাসনিক প্রধান বা উপাচার্যের মাধ্যমে এবং তার দপ্তরটিই হবে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু, যা সাতটি ক্যাম্পাসের কোনো একটিতে হতে পারে কিংবা পৃথক কোনো স্থানে। যদি সাত ক্যাম্পাসের কোনো একটিতে প্রশাসনিক প্রধানের দপ্তর স্থাপিত হয় তাহলে সঙ্গত কারণেই অন্য ছয়টি ক্যাম্পাস তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যা নতুন ধরনের অনেকগুলো বৈষম্যের সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের বৈষম্য থেকে ভবিষ্যতে প্রতিটি ক্যাম্পাস স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পৃথকীকরণের দাবি তুললে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। প্রশাসনিক ভবন যেখানেই স্থাপন করা হোক ক্যাম্পাসগুলোর প্রশাসন মূলত ওই একই আবহে চলবে, এখন যেরূপ চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। মোটকথা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন সাতটি ক্যাম্পাস একটি প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় নিয়ন্ত্রণ করে এর মান বজায় রাখা দুরূহ। আবার সাতটি ক্যাম্পাসের জন্য কমবেশি পাঁচ হাজার শিক্ষক প্রয়োজন। এ বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে সরাসরি নিয়োগ দেয়া হলে এখানে নিম্ন-মানসম্পন্ন শিক্ষকই বেশি নিয়োগ পাবে। কারণ একটি বিসিএস পরীক্ষায় এক ব্যাচে এক হাজারের অধিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে গেলেই কাম্যমান ধরে রাখা সম্ভব হয় না। সেখানে যদি একসঙ্গে পাঁচ হাজার নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে তাদের মান হবে চূড়ান্তভাবে হতাশাজনক। আবার স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটি একটি আইন দ্বারা পরিচালিত হবে এবং প্রতিটি ক্যাম্পাসের জন্য পৃথক নিয়োগ বিধি প্রণয়ন করা যুক্তিযুক্ত হবে না। একই নিয়োগবিধির অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ন্যায়সঙ্গতভাবেই আন্তঃক্যাম্পাস বদলির আওতায় থাকার দাবি তুলতে পারে এবং এর ফলে কোনো অস্থিরতার জন্ম হয় কি না সেটিও কর্তৃপক্ষকে পূর্ব থেকেই বিবেচনায় রাখতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, ডিসিইউ’র একাডেমিক মান ও প্রশাসনিক জটিলতা এড়ানোর জন্য হলেও বিসিএস শিক্ষকদের প্রাধান্য দেয়া সমীচীন।
আবার ক্যাম্পাস সাতটি হলেও যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় একটি সেহেতু এখানে একীভূত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি কোনো ক্যাম্পাস পরীক্ষার প্রস্তুতি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে না পারে তাহলে পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে। আর সিলেবাস শেষ না করে পরীক্ষা গ্রহণ করলে তা হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতির অনুবৃত্তি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলমান বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই ছিল। মূলত আকাশচুম্বী সেশনজট নিরসনের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও এটি বর্তমানে প্রধানত একটি পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
সাত কলেজে বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগত মান ঠিক রাখতে হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক চতুর্থাংশে নেমে আসবে। সেক্ষেত্রে প্রায় দেড় লক্ষ শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে এবং ইডেন কলেজ ও বদরুন্নেছা কলেজ নারী শিক্ষায় যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে তাও সংকুচিত হবে। এ বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী কোথায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে এ সমস্যাটিও সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত দাবি, অতীত অভিজ্ঞতা ও বিদ্যমান সীমাবদ্ধতাসমূহ বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ করে অগ্রসর হলে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়’ শিক্ষার্থীদের মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার আন্দোলনটি সার্থক ও ফলপ্রসূ হতে বাধ্য।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, কবি ও কলাম লেখক।