গাজার মানুষের কাছে এই মুহূর্তে তাদের প্রিয় মাতৃভূমি বেঁচে থাকার নয় মৃত্যুর অপর নাম। অথচ ইসরায়েলের হামলায় গাজা এখন পৃথিবীর এক টুকরো নরকে পরিণত হয়েছে। ঈদের দিনেও যেন মৃত্যু তাড়া করে ফিরেছে সেখানে। ঈদের দুই দিনে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় কমপক্ষে ৮০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০৫ জন। গত ৩১ মার্চ সোমবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
খবরে বলা হয়, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর থেকে গাজায় এক হাজার জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এর ফলে অবরুদ্ধ এই উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা ৫০ হাজার ৩৫০ ছাড়িয়ে গেছে। খবরে বলা হয়, ঈদুল ফিতরের প্রথম দিন ৫৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং ১৮৯ জন আহত হন। টেলিগ্রামে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয় ২০২৫ সালের ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে শুরু করা ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা এক হাজার একজনে পৌঁছেছে এবং দুই হাজার ৩৫৯ জন আহত হয়েছেন। যুদ্ধ বিরতির পরেও নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে ইসরায়েল। অথচ বিশ্ব নির্বিকার। এখানে মানবতা অন্ধ, মানবতাবাদী সংগঠনগুলো অন্ধ। পুরো বিশ্ব এখন চোখ বুজে আছে অন্ধকারে। গত ১৫ মাসের যুদ্ধে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৪৯ হাজার ৬১৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন এক লাখ ১২ হাজার ৯৫০ জন। সেইসঙ্গে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া হয়েছে।
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত চালানো ইসরায়েলের হামলায় নিহত ৫০ হাজার ৩৫৭ ফিলিস্তিনি এবং আহতের সংখ্যা বেড়ে এক লাখ ১৪ হাজার ৪০০ জনে পৌঁছেছে। সেইসঙ্গে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাতে তাদের নতুন হামলা জোরদারের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে সেখানে ফের জোরপূর্বক উচ্ছেদের আদেশ ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয় বলতে ফিলিস্তিনে আর কিছু থাকছে না। এখনও পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান এসব কিছুই রয়েছে কিন্তু কোনো কিছু আমলে নেয়নি ইসরায়েল। ইসরায়েলের জন্য এ যেন পৃথিবীর তাবৎ রাষ্ট্র, আইন এবং সংস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখানো। এসব মাথায় না নিয়েই ফিলিস্তিনের গাজায় নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। সেখানকার শিশুরা এখন আর বাচতে চায় না। ওরা চায় একটু শান্তি। বহুদিন ধরে তো সেখানকার শিশুরা স্কুলে যায় না, খেলাধূূলা করে না, পুষ্টিকর খাবার পায় না এবং শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারে না। সুতরাং এখন তারা চায় মৃত্যু! সম্ভবত পৃথিবীর কাছে এটাই তাদের পাওনা। সভ্যতার কাছে এটাই একমাত্র দাবি এবং আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। পৃথিবী নিশ্চুপ রয়েছে গাজা প্রশ্নে। উপত্যকাটিতে নিহত ফিলিন্তিনির সংখ্যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। শনিবার থেকে আগের ৪৮ ঘণ্টায়ও ১৩০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এরপরও ইসরায়েল বলছে, হামাসকে নির্মূল করতে তাদের এ হামলা। দশকের পর দশক ধরে চলে আসা ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যকার অমিমাংসিত বিষয় নিয়ে চলা যুদ্ধে প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির তৈরি করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরীহ ফিলিস্তিনিরা এর নির্মম শিকার হচ্ছে। ইসরায়েল সর্বাত্মক অভিযান চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের ব্যাপক অভিযানে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। হামাসের এই হামলা ৫০ বছরের আগের একটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মিশর ও সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট অভিযান চালায় ইসরায়েলে। সেই সংঘাত ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, অক্টোবর যুদ্ধ, রমজান যুদ্ধ, ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছিল।
এখন আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে। গাজার একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতালটি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যুদ্ধের একটি নীতি হলো হাসপাতাল বা সেবাখাতগুলো ধ্বংস না করা। এটি মানবতার বিষয়। ইসরায়েল মানবতার কোনো শর্তই পালন করেনি। বা এখনও করছে না। হয়তো এ হামলায় কেউ কেউ বেঁচে যাবেন। যদি বেঁচেও থাকেন যারা ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে বেঁচে থাকবেন তাদের এই ক্ষত দীর্ঘ হবে। সেটি এত দীর্ঘ যে, মরে যাওয়া এর থেকে বেশি ভালো মনে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামোগুলো পুনর্নিমাণে লেগে যাবে বহু সময়। সেটি এত দীর্ঘ যে, মানুষগুলোকে পশুর মতো জীবনযাপন করতে হবে। আজকের এই পরিস্থিতির পেছনেও রয়েছে ইতিহাস। এর শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ হাজারের বেশি মানুষ। যাদের ৮৭ শতাংশই ফিলিস্তিনি। বিভিন্ন সময় এসব যুদ্ধে রক্তপাত ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রাও ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়। বাস্তুচুত্য হয় হাজার হাজার মানুষ। মায়ের কোলে থাকা শিশুরাও এই নির্মমতা থেকে বাদ যায় না। এবারের যুদ্ধেও অসংখ্য শিশু এই নিমর্মতার শিকার হয়েছে। ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনিদের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন বা ইনতিফাদার মধ্য দিয়ে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। সে সময় এই সংঘর্ষে নিহত হয় বহু মানুষ। যা স্থায়ী হয়েছিল ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। যদিও এর সমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির স্বাক্ষরের মাধ্যমে। এরপর বড় সংঘাত হয় ২০০০ সালে। যার কারণ ছিল ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির ব্যর্থতা।
ইসরায়েলের আধুনিক প্রযুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে হামাস এই হামলা চালায়। বরাবরই ফিলিস্তিনের ওপর হামলার ঘটনায় বিশ্বে ধিক্কার ওঠে। কারণ বছরের পর বছর ধরে তারা নিগৃহীত হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলো ঘনিষ্টভাবে জোটবদ্ধ। যে কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে কার্যকর করা সম্ভব না। উভয় পক্ষের দ্বিমতের যে জায়গাগুলো যেমন জেরুজালেম, শরণার্থী ফিরে আসার অধিকার এবং সীমান্তের মতো মৌলিক ইস্যুগুলোর সমাধানে পৌঁছানো প্রয়োজন। উভয় পক্ষের মধ্যে তৈরি করতে হবে বিশ্বাসের সম্পর্ক। গাজায় একটি স্থায়ী সমাধান করতে হলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশ ও অন্যান্য দেশ একত্রে শান্তির পথ তৈরি করতে হবে এবং তা স্থায়ীভাবে মেনে চলতে ইসরায়েলকে সম্মত করাতে হবে। যুদ্ধ বিরতি হলো অথচ তা ইসরায়েল পালন করছে না। আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেটি পালন করাতেও খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করছে না। কেন করছে না? ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। অথচ ফিলিস্থিনিদের সঙ্গে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। ফিলিস্তিনিদের অধিকার বিষয়ে বিশ্বকে একমত হতে হবে এবং তাদের ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এভাবে আর কত নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটবে যাদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিনি? ইসরায়েলের একের পর এক আক্রমণে ফিলিস্তিনের অনেক এলাকা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কতদিনে ওই অঞ্চলে একটি স্থায়ী সমাধান আসবে সেটাও নিশ্চিত নয়। যুদ্ধ এবং শান্তি পরস্পর বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বর্তমান বিশ্বে দুটো বিষয়ই পাশাপাশি চলছে। একদিকে একে অন্যকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য ছুড়ছে অন্যদিকে শান্তির বুলি। মানুষ আসলে কী চায় তা মনে হয় নিজেও জানে না। যাদের মাথার উপর ছাদ ছিল; আজ নেই। মানুষের তৈরি অস্ত্র সেই ছাদ ধ্বংস করে দিয়েছে। পৃথিবীর মানুষকে আসলে গভীরভাবে ভাবতে হবে যে তারা কী চায়, যুদ্ধ না শান্তি? অস্ত্র না মানবতা?
এসব তো পাশাপাশি চলতে পারে না। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলা যুদ্ধবিরতি অতীতেও কার্যকরের পর আবারও উভয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। অতীতেও ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনে বিশ্বে দাবি জোরালো হয়েছে। পরিকল্পনা হয়েছে, প্রস্তাব হয়েছে কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ফল পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুই একটি স্বাধীন ভূমির প্রত্যাশা করে। যুদ্ধ বা হানাহানি জন্ম থেকে প্রত্যাশা করে না। কিন্তু ফিলিস্তিনে জন্ম নেয়া একটি শিশু কেন সেই স্বপ্ন দেখতে পারবে না এর উত্তর কারও কাছে নেই। ফলে পৃথিবীর স্বার্থে পৌঁছাতে হবে কোনো স্থায়ী সমাধানে। এভাবে পক্ষ-বিপক্ষ একটি বিশ্বযুদ্ধে অথবা ব্যাপক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এর মধ্যে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সুতরাং পৃথিবীর স্বার্থেই ইসরায়েলের এই হামলা বন্ধ করতে হবে এবং মানবিক উপায়ে সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। ভবিষ্যতে পৃথিবীকে এর উত্তর দিতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হলেও কেউ কোনো কর্ণপাত করছে না। একটি অন্যায় আরও শত শত অন্যায়ের জন্ম দেয়। এটিও দিবে। তখন বিশ্ব এভাবে চুপ থাকবে তো? ফিলিস্তিনে জন্ম নেয়া শিশুটিও কিন্তু আমার এবং আপনার শিশুর মতোই!