সি-সেকশন বা সিজারিয়ান সেকশনের গুরুত্ব অনেক। সুস্থ, স্বাভাবিক শিশুর জন্ম এবং নিরাপদ মাতৃত্বের বিষয়ে এখন সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়। আর তাই ২০২৫ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘স্বাস্থ্যকর সূচনা, আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ’। অর্থাৎ, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য হলো সুস্থ পরিবার ও সমাজের ভিত্তি, যা আমাদের সবার জন্য আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় সিজারিয়ান সেকশন করা হয় একজন দক্ষ প্রসূতিবিদের (অবসটেট্রিশিয়ান) মাধ্যমে। কয়েকটি ধাপে এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে ৪৫-৬০ মিনিট সময় লাগে। প্রথম ধাপে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা (ব্লাড সুগার, ব্লাড গ্রুপ, হিমোগ্লোবিন ইত্যাদি) করা হয়, মূত্রথলি ফাঁকা করার জন্য ক্যাথেটার লাগানো হয়, অনেক সময় ইন্ট্রাভেনাস ড্রিপ তৈরি করা হয় এবং সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অপারেশনের প্রায় এক ঘণ্টা আগে প্রফিল্যাক্টিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়।
এরপর একজন দক্ষ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট কোমর থেকে নিচের অংশ অবশ করার জন্য স্পাইনাল অথবা এপিডিউরাল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করেন। কিছু ক্ষেত্রে সারা শরীর অবশ করার জন্য জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া ব্যবহার করা হয়। অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার পর সিজারিয়ান সেকশনের মূল কাজটি করা হয়।
একজন প্রসূতিবিদ প্রথমে তলপেটের বিভিন্ন স্তর ট্রান্সভার্স বা ফানিন্সটিল ইনসিজন পদ্ধতিতে ১০-১৫ সেন্টিমিটার ব্যবচ্ছেদ করেন এবং এরপর জরায়ু বা ইউটেরাস কেটে নিরাপদে শিশুকে বের করে আনেন। তবে জরুরি বা জটিল পরিস্থিতিতে ভার্টিকাল ইনসিশন বা খাড়াখাড়িভাবে কাটার পদ্ধতিও ব্যবহার করা হয়।
এরপর শিশুর আমবিলিকল কর্ড বা নাভিরজ্জু কেটে ফেলে মা থকে শিশুকে আলাদা করা হয়। শিশু অপসারণের পর প্লাসেন্টা বের করে ফেলা হয়, জরায়ুর ভেতর পরিষ্কার করা হয় এবং এরপর জরায়ু সেলাই করে দেয়া হয়। এরপর ধাপে ধাপে তলপেটের কাটা অংশের বিভিন্ন লেয়ার সেলাই করে দেয়া হয়।
সিজারিয়ান সেকশনের পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এটি কোনো সাধারণ অপারেশন নয়। এ অপারেশনে দুটি আলাদা ইনসিজন বা কাটার প্রয়োজন পড়ে- একটি তলপেটের চামড়া এবং আরেকটি জরায়ু। কোনো জটিলতা দেখা না দিলে সিজারিয়ান অপারেশনের পর প্রসূতি মায়ের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে প্রায় চার থেকে ছয় সপ্তাহ সময় লেগে যায়।
সারা বিশ্বে বর্তমানে চোখের ক্যাটার্যাক্ট সার্জারির পর সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত অস্ত্রোপচার পদ্ধতি হলো সিজারিয়ান সেকশন। সংক্রমণ প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ও শল্য চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়নের ফলে সিজারিয়ান সেকশন অনেকটা নিরাপদ হলেও এটি ঝুঁকিমুক্ত নয়।
আদর্শ চিকিৎসাব্যবস্থায় সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহারের নির্দেশনা আছে। তবে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ নির্দেশনার ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য আছে। যেমন যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর হেলথ অ্যান্ড কেয়ার এক্সিলেন্সের গাইডলাইন অনুযায়ী সিজারিয়ান সেকশন করতে হবে যখন শিশুর বা মায়ের বা উভয়ের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি আছে যেমন- প্লাসেন্টা প্রেভিয়া (গর্ভফুল জরায়ুমুখে ঢেকে রাখা), ফেটাল ডিস্ট্রেস (ভ্রূণের অক্সিজেন স্বল্পতা বা হার্টবিটের সমস্যা), প্রসবের সময় অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যাওয়া, ব্রিচ পজিশন, পূর্বে একাধিক সিজারিয়ানের ইতিহাস থাকা এবং মায়ের অনুরোধ।
আমেরিকান কলেজ অব অবস্টেট্রিসিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকলোজিস্টসের গাইডলাইন অনুযায়ী সি-সেকশনের নির্দেশনাগুলো হলো- ভ্রূণের অস্বাভাবিক হার্ট রেট, মায়ের পেলভিস ছোট হওয়ার কারণে প্রসবজনিত বাধা, ব্রিচ পজিশন, গর্ভে একাধিক শিশু, ইউটেরাইন রাপচার বা ইউটেরাস ফেটে যাওয়া, শিশুর অস্বাভাবিক ওজন (চার কেজি বা তার বেশি), পূর্বে এক বা একাধিক সিজারিয়ান ডেলিভারের ইতিহাস এবং মায়ের ইচ্ছা।
এছাড়া মায়ের প্রি-অ্যাক্লাম্পসিয়া, ইনফেকশন, নাভিরজ্জু পেঁচিয়ে যাওয়া ও হার্টের জটিল অসুখ থাকলেও সিজারিয়ান ডেলিভারির নির্দেশনা রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাও একই রকম। তবে মায়ের অনুরোধ বা ইচ্ছার কারণে সিজারিয়ান সেকশন করতে হলে মাকে এর ঝুঁকি ও বিকল্প সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার বাধ্যবাধকতা আছে। এর বাইরে অন্য কোনো কারণে সিজারিয়ান সেকশন করলে সেটি অপব্যবহার বলে গণ্য হবে।
২০২১ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯০ সালে যেখানে বিশ্বে গড়ে সাত শতাংশ শিশুর জন্ম হতো সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে সেখানে ২০২১ সালে সেটি ছিল ২১ শতাংশ।
অর্থাৎ চার বছর আগে সারা বিশ্বে গড়ে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন শিশু সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করতো। অথচ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারসহ অনুযায়ী মোট প্রসবের মধ্যে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার কোনোমতেই ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। তবে, বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় বাংলাদেশে সিজারিয়ান সেকশনের হার অনেক বেশি।
২০২৪ সালের মার্চে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স-২০২৩’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে দেশে মোট প্রসবের ৪১ দশমিক চার শতাংশ ছিল সিজারিয়ান ডেলিভারি এবং ২০২৩ সালে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ দশমিক সাত শতাংশ। অথচ, বিশ বছর আগে চিত্রটা এরকম ছিল না।
২০০৪ এবং ২০১০ সালে দেশে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ছিল যথাক্রমে মাত্র তিন দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং ১২ দশমিক দুই শতাংশ। অর্থাৎ, ২০ বছরে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৭১ শতাংশ, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত হারের চেয়ে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বেশি।
সিজারিয়ান ডেলিভারির এ মহামারি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এক ধরনের মারাত্মক অসুস্থতার নির্দেশক। এই ৩০ শতাংশ সিজারিয়ান ডেলিভারির কোনো প্রয়োজন ছিল না এবং এটি একটি জীবন রক্ষাকারী অস্ত্রোপচারের অপব্যবহার এতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সংক্রমণ প্রতিরোধে অপারেশনে পূর্বে ও পরে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে সিজারিয়ান অপারেশন একটি নিরাপদ চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে পরিচিতি পেলেও এটি ধীরে ধীরে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এর একটি কারণ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স।
বিএমজে ওপেন জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় সিজারিয়ান অপারেশনের পর ১০-২৫ শতাংশ রোগীর সারজিক্যাল সাইটে বা কাটা অংশে সংক্রমণ দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এ সংক্রমণ হয় ওষুধ প্রতিরোধী বা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু দিয়ে যার ফলে ক্ষতস্থানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে।
এর ফলে উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হয়, অ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করে নতুন জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশন করতে হয় যাতে চিকিৎসার খরচ বেড়ে যায়। নবজাতকের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে, কারণ, সে সময়ে নবজাতক মায়ের সংস্পর্শ এবং মায়ের শালদুধ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত সময় নিউজের একটি প্রতিবেদনে সিজারিয়ান অপারেশন করতে হয়েছিল এমন কয়েকজন প্রসূতি মায়ের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। সে প্রতিবেদনে সাক্ষাৎকার দেয়া সব প্রসূতি মায়েরই সিজারের কাটা জায়গায় গুরুতর ইনফেকশন ধরা পড়েছে।
বলার অপেক্ষা নেই, এরা সবাই ওষুধ প্রতিরোধী সংক্রমণের শিকার, কারণ, সিজারিয়ান অপারেশনের পর উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার পরেও ইনফেকশনের মানে হলো প্রয়োগকৃত অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করেনি। এসব ক্ষেত্রে সংক্রমণকারী ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু ধ্বংসের একমাত্র উপায় অ্যান্টিবায়োটিক সাসেপ্টিবিলিটি টেস্ট করে অন্য কোনো উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, মার্কেটে আছে এমন কার্যকরী অ্যান্টিবায়োটিকের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। এ সমস্যা শুধু সিজারিয়ান অপারেশনের ক্ষেত্রে নয়, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স সব প্রকার সার্জারি বা অস্ত্রোপচারকে এখন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। কারণ, ফোঁড়া কাটা থেকে শুরু করে হার্টের অপারেশন যে কোনো সার্জারিতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা অপরিহার্য।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে নরমাল ডেলিভারি একটি প্রাকৃতিক, পরীক্ষিত ও নিরাপদ পদ্ধতি। এর সুবিধা অনেক। যেমন দ্রুত স্তন্যদান শুরু করতে পারা, প্রসূতি মায়ের মাত্র কয়েকদিনেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা, মা-শিশুর বন্ধন শক্ত হওয়া, শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হওয়া, কম খরচ হওয়া, প্রসব-পরবর্তী জটিলতা কম হওয়া, কম রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি।
তবে, স্বাভাবিক ডেলিভারি সবসময় নিরাপদ হয় না। কিছু সময় এটি মা অথবা শিশু বা উভয়ের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
শুধুমাত্র সেসব ক্ষেত্রেই নরমাল ডেলিভারির পরিবর্তে সিজারিয়ান ডেলিভারির অপশনটি ব্যবহার করা উচিত। প্রসূতি মায়ের বা শিশুর স্বাভাবিক ডেলিভারিতে কোনো সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা না থাকার পরেও ইচ্ছা করে সিজারিয়ান ডেলিভারি বেছে নেয়া ভালো সিদ্ধান্ত নয়। এতে মা ও শিশু উভয়েই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার দিকে পতিত হন।
গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত দেশে যেসব প্রসূতি মায়ের স্বাভাবিক ডেলিভারির ক্ষেত্রে ঝুঁকি কম ছিল সেসব মায়েদের সিজারিয়ান ডেলিভারির কারণে মাতৃমৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় চারগুণ বেড়ে যায়। অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশে এর হার বেশি হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তাই, সার্বিক বিবেচনায় সিজারিয়ান ডেলিভারিকে ফ্যাশন হিসেবে বা উঁচু সামাজিক মর্যাদার নির্দেশক হিসেবে কোনোভাবেই ব্যবহার করা উচিত নয়। চিকিৎসকদের বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিজেদের আর্থিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে রোগীকে সিজারিয়ান ডেলিভারিতে উৎসাহিত করা বা কোনো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ডেলিভারির ব্যাপারে ভীতিসঞ্চার করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সরকারের উচিত সিজারিয়ান ডেলিভারির ব্যাপারে দ্রুত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা এবং তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা। এর ফলে, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারি কমবে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ কমবে, ওষুধ প্রতিরোধী সংক্রমণের হার কমবে, মা ও শিশু স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতি হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।