ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভাষার বৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ এক নাম রাজবংশী

মো. তাহমিদ রহমান
ভাষার বৈচিত্র্যের সমৃদ্ধ এক নাম রাজবংশী

হবার পারোং শুকান গাছ, পাত-পুতারি নাই/এই দেহাডাত কত পখিক দিছুং একদিন ঠাঁই/কত লোকের মাথার উপর ছায়া হয়ে ছিনু/কত জনের হাপোনিক্কাশ বুকোত টানি নিনু/পাত-পুতারি, ছাল্টা-শিপা সগায় নেগায় নেগায়/ঠলঠলিয়া নাগে শ্যাষে মোকে রুগী বানায়/এলা না হয় ফুল ফুটে না বাসনা ছড়াং না/ফল ধরে না ডালে ডালে পাতারিও নড়াং না/যেলা ছিল দিবার মতন সবে দিসুং তোমাক/তোমার সুখে খুশি হয়া ছিট্টি দিসুং জোনাক/নিছাল্টিয়া হইসুং এলা- কাহ না আসেন গোর/জিউ থাকিতে মরা ভাবেন! সব দোষ কি মোর?

পঙ্ক্তিগুলো রাজবংশী ভাষায় লেখা যেখানে একজন পরিবারের অশীতিপর কর্তার হৃদয়ের হাহাকার ফুটে উঠেছে। আজকের আলোচনার সঙ্গে উপর্যুক্ত কবিতাটি প্রাসঙ্গিক তাই সেটা দিয়েই লেখাটি শুরু করলাম। বাংলাদেশ যেন আঞ্চলিক ভাষার এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আগমনের কারণে আঞ্চলিক ভাষা অনেক সমৃদ্ধি লাভ করেছে। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের সুপ্রাচীনকাল থেকে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠী রাজবংশী। তাদের স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে? বস্তুত উন্নততর ভাব ও চিন্তা প্রকাশের জন্যই তারা রাজবংশী ভাষা ব্যবহার করে। বাংলাদেশের রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলার মানুষ যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে সেটাই মূলত রাজবংশী ভাষা। এটি মূলত ইন্দো-আর্য পরিবারভুক্ত ভাষা। বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর জনপদের পাশাপাশি ভারতের মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং সম্বলপুর (ওড়িশা), উত্তর বঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং দার্জিলিংয়ের তরাই অঞ্চল, বিহারের কাটিহার, পূণিয়া এবং কিষানগঞ্জ জেলার কিছু অঞ্চল, নেপালের মোরং এবং ঝাপা জেলা, ভূটানের কিছু অঞ্চলের মানুষ এই রাজবংশী ভাষায় কথা বলে। পাশাপাশি অবস্থিত চারটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ডে এই ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই কোটিরও অধিক। ভাষা হচ্ছে মানুষের এমন এক অনন্য সুলভ বৈশিষ্ট্য যা অন্য প্রাণী থেকে মানুষকে স্বতন্ত্র দান করেছে। রাজবংশী ভাষারও আছে সুপ্রাচীন সমৃদ্ধ ইতিহাস। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে লোকগণনার প্রাক্কালে কলকাতা কেন্দ্রীক বাঙালিরা এ অঞ্চলের মানুষের উপর প্রমিত বাংলা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে এই জনগোষ্ঠীর বিদ্বজনেরা ‘দেশি মানসির দেশি ভাষা’ প্রত্যয়কে ধারণ করে বিদ্রোহ করে। রাজবংশী ভাষার ইতিহাস দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময়। এটি মূলত কামতাপুর রাজ্যের অধিবাসীদের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল যা সময়ের পরিক্রমায় বর্তমান রূপ লাভ করেছে। ড. রামেশ্বরের মতে বাংলা ভাষার প্রধান পাঁচটি আঞ্চলিক বা উপভাষার মধ্যে রাজবংশী ভাষা অন্যতম। রাজবংশী ভাষায় বাংলা ক্রিয়া পদে ও বিশেষ্য পদের শেষে ও মাঝে ‘ঙ’, ‘ং’ এবং ‘ম’-এর উচ্চারণ ও ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। রাজবংশী ভাষা তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লাভ করছে এ অঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত সর্বনামগুলোর দ্বারা। এসব শব্দ রাজবংশীদের কথ্য ভাষায় বহুল প্রচলন রয়েছে। রাজবংশী ভাষা যে কত বৈচিত্র্য, সমৃদ্ধ ও ব্যবহার উপযোগী তার টের পাওয়া যায় উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গানে। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাবার ভাত ও মাছ হলেও রাজবংশীদের ধারায় উত্তরাঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী খাবার হয়ে দাঁড়িয়েছে শুঁটকি, শুকাতি, সিদল ভর্তা, মাছ পাতা, লাফা ও পাট শাকের প্যালকা ইত্যাদি। রাজবংশী ভাষা সাহিত্যে ভাওয়াইয়া গান ও ক্ষ্যাপা গানসমৃদ্ধ স্থান দখল করে আছে। রাজবংশী ভাষার পাশাপাশি কুরুখ ভাষারও সুস্পষ্ট ও গভীরতর প্রভাব রয়েছে পঞ্চগড় জেলার উত্তরাংশের তেঁতুলিয়া অঞ্চলে। ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের পশ্চিমাঞ্চলে যে রাজবংশী ভাষা ব্যবহৃত হয় তার সঙ্গে শত মাইল দূরের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর অঞ্চলের ভাষার মধ্যেও ব্যাপক মিল পাওয়া যায়। প্রবাহমান কালের বিবর্তনে রাজবংশী ভাষা ও সংস্কৃতি বর্তমানে উত্তরবঙ্গের সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। রাজবংশী ভাষা শুধু একটি ভাষাগত মাধ্যম নয়, এটি উত্তরবঙ্গের জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সব আঞ্চলিক ভাষাকে সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। তাহলেই রাজবংশী ভাষা তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মূল্যবোধকে টিকিয়ে রেখে গৌরবময় ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে।

লেখক : প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ), নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত