ঢাকা বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ক্ষমতার খেলা নয়, দেশের কল্যাণ চাই

সাইদুর রহমান
ক্ষমতার খেলা নয়, দেশের কল্যাণ চাই

রাজনীতি একসময় ছিল মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই, সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার দৃপ্ত শপথ। বিশ্ব ইতিহাস হোক বা বাংলাদেশ- রাজনীতি ছিল সেবার, ত্যাগের, আর মানুষকে মুক্ত করার উপায়। কিন্তু এখন? এখন রাজনীতির নাম শুনলেই মানুষের মনে সন্দেহ, বিরক্তি ও হতাশা ভর করে। রাজনীতি আজ যেন হয়ে উঠেছে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা- কারা কত বেশি স্লোগান দিতে পারে, কত বেশি পোস্টার টানাতে পারে, কত বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভাঙতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, লাখো প্রাণের বিনিময়ে। সেই মানুষ এখন নিজের ভোট দিতে ভয় পায়, মতপ্রকাশ করতে দ্বিধায় পড়ে। সেই দেশেই এখন অনেকে ভাবে- রাজনীতির মানে কী শুধুই ‘পদ’, ‘ক্ষমতা’ আর ‘নির্বাচনি জোট’? সেই দেশেই অনেক তরুণ এখন বলে- ‘ভাই, আমি রাজনীতি করি না, আমার রাজনীতির প্রতি আগ্রহ নেই।’

কিন্তু প্রশ্ন হলো- রাজনীতি যদি জনগণের কল্যাণের জন্য হয়, তাহলে সেই রাজনীতি থেকে জনগণ এত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন? আমরা যারা রাজনীতিক নই, যারা কোনো দলের সদস্য নই, তাদের কি কিছু বলার, ভাবার, করার অধিকার নেই? আমরা কি শুধু দর্শক হয়ে থাকব, আর আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে কিছু রাজনৈতিক চক্রের ছক কষা ষড়যন্ত্রে? এই লেখার উদ্দেশ্য কাউকে দোষারোপ করা নয়। বরং একটি উপলব্ধি ছড়িয়ে দেওয়া- আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, আর ভবিষ্যতে কোথায় যেতে চাই।

ক্ষমতা কে নেবে, সেটা বড় কথা নয়- কিন্তু দেশটা কীভাবে এগোবে, সেটাই হওয়া উচিত মূল প্রশ্ন। এখানেই প্রয়োজন অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া, বর্তমানকে বিশ্লেষণ করা, আর ভবিষ্যতের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার। এই লেখায় আমরা সেই চেষ্টাই করব- একজন সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

বাংলাদেশের জন্ম শুধু একটি মানচিত্রে নতুন রেখা টানার গল্প নয়- এটি এক গৌরবময় আন্দোলনের ফসল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি অধ্যায়েই জনগণের ইচ্ছা ও অধিকার ছিল মূল চালিকাশক্তি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে এসে আমাদের উচিত ছিল উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও ন্যায়ের শাসনে একটি উদাহরণ হয়ে ওঠা। কিন্তু বাস্তবতা হলো- দেশটি এখন রাজনৈতিক বিভক্তি, অস্থিরতা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রের চক্রে আটকে গেছে। প্রশ্ন জাগে- আমরা কি আদৌ স্বাধীনতা অর্জনের মূল উদ্দেশ্যগুলো অর্জন করতে পেরেছি?

বাংলাদেশের ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে- অবিচার, আত্মসাৎ, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এই জাতি কখনও স্থির থাকে না।

কিন্তু একইসঙ্গে এটি প্রমাণ করে- যখন নেতৃত্ব নীতিহীন হয়, রাজনীতি হয় দলীয় স্বার্থে সীমাবদ্ধ, তখন জাতি পথভ্রষ্ট হয়। ৭৫-এর ভয়াল রাত, ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন- সবকিছুই আমাদের শেখায়, জনমত উপেক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদে কোনো গোষ্ঠী টিকে থাকতে পারে না। এই ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু আদর্শের জায়গা চিরস্থায়ী হতে পারে। নেতৃত্ব মানে শাসন নয়, সেবা। রাজনীতি মানে আধিপত্য নয়, দায়িত্ব। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা দেখেছি উত্থান-পতনের চিত্র। রাষ্ট্রপতির শাসন থেকে শুরু করে সামরিক শাসন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন, দলীয় সংঘর্ষ এবং ক্ষমতার লোভে জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া- এসবই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ।

৫ আগস্ট ২০২৪ : একটি উপলব্ধির দিন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে আওয়ামী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার নতুন ইঙ্গিত দেখা যায়। কিছু দল নির্বাচনের দাবি তোলে, কেউ আবার অসাংবিধানিক ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু এইসব আলাপের কেন্দ্রে কী জনগণের কল্যাণ? নাকি সবই কৌশল- নতুন করে ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি বানানো? দীর্ঘ অস্থিরতা, হতাশা আর বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে ৫ আগস্ট ২০২৪ বাংলাদেশকে এনে দেয় এক নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা।

স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর ছাত্র-জনতার আত্মদানে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তা ছিল শুধু ক্ষমতা বদলের আহ্বান নয়- বরং ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, স্বচ্ছ, মানবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন। এই দিনে, দেশের মানুষ ইতিহাসের অন্যতম একটি শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের সাক্ষী হয়। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত মানবতাবাদী ড. মুহাম্মাদ ইউনূস দায়িত্ব নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে- যাকে কেউ কেউ আখ্যা দিয়েছেন ‘নতুন বাংলাদেশের স্থপতি’।

বাংলাদেশ ২.০ এই নামে আমরা কী বুঝি? এটি শুধু রাজনৈতিক রূপান্তর নয়, বরং একটি মানসিক, নৈতিক ও দৃষ্টিভঙ্গির বিপ্লব। যেখানে- ?নাগরিক অধিকার আর চুপচাপ মেনে নেয়া নয়, সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়। ?রাজনীতি হয় রাষ্ট্র সেবার মাধ্যম, ব্যক্তিস্বার্থে বলি দেয়ার জায়গা নয়। ?ইসলামী মূল্যবোধ ও মানবিক দর্শন নতুন নেতৃত্বে নৈতিকতার মানদ- স্থির করে। ?স্বাধীনতার চেতনা শুধু স্মারক দিবসে আটকে না থেকে ন্যায়ের ভিত গড়ে দেয়। এই ‘২.০ ভার্সন’ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের এক নয়া সূচনা।

ড. ইউনূসের নেতৃত্ব সেই জনভিত্তিক রাজনীতির প্রতীক, যা লুটপাট বা স্বজনপ্রীতির বদলে ?দায়িত্ব, জবাবদিহিতা এবং প্রগতিশীল চিন্তার উপর দাঁড়িয়ে। বিংশ শতাব্দীর ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ বা স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামের মতোই ২০২৪-এর ৫ আগস্টেও নতুন প্রজন্মের আওয়াজেই কেঁপে ওঠে শাসনের ভিত্তি। তারা আর কোনো দলের জিঞ্জিরে নয়- তারা চেয়েছে একটি ‘মানুষভিত্তিক বাংলাদেশ’, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-দলমত নির্বিশেষে সবার সম্মান ও সুযোগ নিশ্চিত। এই মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি জাতির প্রত্যাশা- তারা যেন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়। কেননা, মানুষের ধৈর্যের সীমা থাকে। তারা পরিবর্তন চায়, কিন্তু সেটা দায়িত্বশীল নেতৃত্বের মাধ্যমে- বিশৃঙ্খলা নয়।

তরুণদের জাগরণই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। যারা ভবিষ্যতের নেতা, তাদের মাঝে যদি আজ নীরবতা, কৌতূহলহীনতা আর ‘রাজনীতি মানেই নোংরামি’- এই ধারণা বাসা বাঁধে, তাহলে আগামীতে রাষ্ট্র কাঠামোই দুর্বল হয়ে পড়বে। তরুণদের বুঝতে হবে- তারা যদি নেতৃত্বের চর্চা থেকে নিজেকে দূরে রাখে, তবে নেতৃত্ব দখল করে নেবে দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালোভী গোষ্ঠী। অতএব, গঠনমূলক রাজনীতি, নৈতিক নেতৃত্ব এবং জনকল্যাণমুখী চিন্তার বিকাশ জরুরি।

বাংলাদেশ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ভবিষ্যৎনির্ভর করছে আমরা এখন কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি তার ওপর। আমরা কি বারবার পুরোনো ভুলে ফিরব, নাকি নতুন পথ খুঁজে নেব? রাজনীতি যেন আর ক্ষমতার খেলা না হয়। রাজনীতি হোক সেবার মঞ্চ, আদর্শের পথে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার। ক্ষমতা নয়, দেশের কল্যাণ হোক আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।

‘এই দেশ আমাদের, আমাদের সন্তানদের। এ দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার দায়িত্বও আমাদের। তাই এখনই সময়-ক্ষমতার মোহ ভেঙে সত্যিকারের পরিবর্তনের পথে হাঁটার।’

বাংলাদেশ ২.০ শুধু একটি ধারণা নয়- এটি একটি সম্ভাবনা। আমরা চাই, ?একটি জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা, ?একটি নৈতিক শিক্ষানীতিনির্ভর প্রজন্ম, ?একটি পেশাদার ও অরাজনৈতিক প্রশাসন, একটি বিনিয়োগবান্ধব, কর্মসংস্থানমুখী অর্থনীতি এতদিন আমরা যেসব অন্ধকার দেখেছি, হয়তো এবার আলোর পথ খোঁজার সময়। রাষ্ট্রে গণতন্ত্র শুধু ব্যালট বাক্সে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং জনগণের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যম হয়ে উঠবে। এই সুযোগ ইতিহাস বারবার দেয় না- ৫ আগস্ট ২০২৪ শুধুমাত্র একটি তারিখ নয়, এটি নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। চাইলে আমরা এটিকে শুধু একটি ‘ঘটনা’ হিসেবে ভুলে যেতে পারি- আবার চাইলে এটিকে একটি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত