বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সম্প্রতি ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধির প্রয়াস অব্যাহত আছে। গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফাইবার-অপটিক ইন্টারনেট বসানোতে ভূমিমূল্য, লজিস্টিক ও প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছে। এ সমস্যা সমাধানে লো-অর্থ উপগ্রহ নেটওয়ার্ক যেমন স্টারলিংকের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি গুরুত্ব বহন করে। স্টারলিংক উচ্চণ্ডগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা সরবরাহের মাধ্যমে দূরবর্তী এলাকায় ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে পারে।
স্টারলিংক হলো ঝঢ়ধপবঢ-এর একটি সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সহায় সংস্থা ঝঃধৎষরহশ ঝবৎারপবং, খখঈ দ্বারা পরিচালিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কনস্টেলেশন। ২০১৫ সালে প্রকল্প শুরু হওয়ার পর ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম ৬০টি প্রোটোটাইপ উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়। প্রকল্পের লক্ষ্য হলো পৃথিবীর প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলে উচ্চণ্ডগতির ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়া, যেখানে বর্তমান অবকাঠামো অপ্রতুল বা অস্থিতিশীল। স্টারলিংক নেটওয়ার্কে বর্তমানে হাজার হাজার ছোট খঊঙ স্যাটেলাইট একে অপরের সঙ্গে লেজারলিঙ্ক ও ভাউন্ড-স্টেশনগুলোর মাধ্যমে যুক্ত। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ডাউনলোড গতি ২৫-২২০ এমবিপিএস এবং আপলোড গতি ১১-৩৪ এমবিপিএস পর্যবেক্ষিত। গেমিং ও লাইভস্ট্রিমিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় লেটেন্সি ২০-৫০ মিলিসেকেন্ডের মধ্যে থাকে, যা অনেক গুণ কম প্রচলিত এঊঙ স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের তুলনায়। লো-অর্থ কক্ষপথের কারণে বায়ুপ্রবাহ, আবহাওয়া পরিবর্তন ও গ্রাউন্ড স্টেশনের অবস্থানের উপর নির্ভর করে লিঙ্ক হ্যান্ডওভার চ্যালেঞ্জ থাকে। স্টারলিংক কনস্টেলেশনে বর্তমানে ৭,১৩৫টিরও বেশি স্যাটেলাইট রয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী নিরাপদ কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করে। এই স্যাটেলাইটসমূহ বিভিন্ন কক্ষপথে পর্যায়ক্রমে স্থাপন করা হচ্ছে, যাতে বিশ্বের প্রায় সব কোণে ন্যূনতম স্তরে সেবা পৌঁছায় ।
বিভিন্ন দেশ থেকে নেয়া পরিমাপ অনুযায়ী, পিক সময়ে গড় লেটেন্সি ৩৩ মিলিসেকেন্ডে নেমেছে, যেখানে পূর্বে ৪৮.৫ মিলিসেকেন্ড ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন অংশে লেটেন্সি ২০-৫০ মিলিসেকেন্ডের মধ্যে ওঠানামা করে, যা অনেক গেমিং ও রিয়েল-টাইম যোগাযোগের জন্য উপযুক্ত। গতি ও লেটেন্সি স্থিতিশীল করতে ঝঃধৎষরহশ প্রতি ১৫ সেকেন্ডে লক্ষ লক্ষ রাউটারের তথ্য সংগ্রহ করে পারফরম্যান্স অপটিমাইজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেসিডেনশিয়াল প্ল্যানের মাসিক মূল্য $৩৫ (প্রায় ?৪,০০০) থেকে শুরু এবং গ্লোবাল রোয়াম ৫০ জিবি প্ল্যান $৫০/মাস, আনলিমিটেড $১৬৫/মাস। অন্যান্য দেশে খরচ অবস্থানভিত্তিক পরিবর্তিত হয়; ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু অঞ্চলে মাসিক খরচ $১০০-১২০ (ঐক্য ?১০,০০০-?১২,০০০) পর্যায়ে রয়ে গেছে। টার্মিনাল (ডিশ) এককালীন প্রায় $৩৪৯-$৫৯৯ (?৪২,৫০০-?৬৫,০০০) ব্যয় করে কিনতে হয়। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে আগামী তিন মাসের মধ্যে স্টারলিংক ইন্টারনেট পরিষেবা চুক্তি সম্পন্ন করা সম্ভব। স্বাধীনতা দিবসের পর ঘোষণা অনুযায়ী, সরকার পর্যায়ক্রমে মানসম্মত গ্রামীণ সংযোগের লক্ষ্যে উচ্চণ্ডগতির স্যাটেলাইট ইন্টারনেট আনবে। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী, স্টারলিংক বা অন্য কোনো ঘএঝঙ স্যাটেলাইট অপারেটরকে সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচার বা উঞঐ সেবা দেয়া যাবে না। গোপন নজরদারি ও সার্ভিস বন্ধ করার আইনগত ক্ষমতা সংরক্ষিত থাকবে, যা নাগরিক স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার ক্ষেত্রে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সরকারি দপ্তর সতর্ক করেছে যে, ‘স্টারলিংক সার্ভিস যে কোনো সময় নিয়ন্ত্রণ বা স্থগিত করা যেতে পারে’। মূল্যসীমা উচ্চ থাকায় বিপুল সংখ্যক দরিদ্র বা মাঝারি আয়ের পরিবার স্টারলিংক গ্রহণে অক্ষম। গ্রামীণ অঞ্চলে টেলিকম অবকাঠামো না থাকায় গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের ক্ষেত্রে জমি, বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সরকারি সেন্সরশিপ ও সার্ভেইলেন্স ব্যবস্থার কারণে নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ থাকছে। দূর্গম অঞ্চলে উচ্চণ্ডগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দিয়ে ডিজিটাল শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়ন সম্ভব। বিপর্যয়-প্রবণ অঞ্চলে ইমারজেন্সি রেসপন্স সেবা দ্রুতগতি আনতে স্টারলিংকের রেডন্ড্যান্ট লিঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বেসরকারি খাতে ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করবে।
গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রডব্যান্ড সংযোগে স্টারলিংক ডিজিটাল বিভাজন কমাতে পারে। এ-লার্নিং, টেলিমেডিসিন ও স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণে সুবিধা চলাচল বাড়িয়ে দেবে। ইন্টারনেট-ভিত্তিক স্টার্টআপ ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (ঝগঊ) সম্প্রসারণে সহায়তা করবে। ফ্রিল্যান্সিং ও ডিজিটাল সার্ভিস বাণিজ্যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ তৈরি হবে। সরকারি নজরদারি ক্ষমতা বাড়ায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন ও অযাচিত তদারকি ঝুঁকি বাড়তে পারে। যুদ্ধক্ষেত্র ও নিরাপত্তাজনিত কারণেও উঁচু-গতির, অপরিবর্তনীয় সংযোগ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ হবে। দেশীয় টেলিকম অপারেটরদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করে গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপিত করলেই সেবা সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। গ্রামীণ বিদ্যুৎ ও সোলার প্যানেল সংমিশ্রিত করে টিংকা পর্যায়ক্রমে ইনস্টলেশন করা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী নানাবিধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (গড়ট) করে প্রযুক্তি স্থানান্তর ও খরচ হ্রাস করা সম্ভব। স্থানীয় আইটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতা তৈরি করা উচিত। লেজার-লিঙ্ক ও মিনি-গ্রাউন্ড স্টেশন প্রযুক্তি উন্নয়ন করে লেটেন্সি আরও কমানো যেতে পারে। ন্যানোস্যাটভিত্তিক পরবর্তী পর্যায়ের খঊঙ প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করতে হবে। স্টারলিংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি ও গ্রামীণ উন্নয়ন পর্বতচূড়ান্ত হতে পারে, তবে খরচ, নীতিমালা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ সমাধান আবশ্যক। সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ গ্রামীণ সংযোগ স্থায়ী করতে সহায়ক হবে। ভবিষ্যতে প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন ও স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশে স্টারলিংক সাফল্যে রূপান্তর করাই সময়োচিত প্রতিশ্রুতি।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা