বিশ্ব রাজনীতিতে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই উত্তপ্ত। পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে এই টানাপোড়েন আবার সামনে এসেছে। ওমান ও রোমে চলছে গোপন আলোচনা। দুই পক্ষ সরাসরি কথা বলছে না, তবুও তাদের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান হচ্ছে। কিন্তু আলোচনার এই প্রচেষ্টার চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে যুদ্ধের শঙ্কা। এই দ্বন্দ্বের শুরু ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব থেকে। তখন যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত রাজা (শাহ) পদচ্যুত হন। ইরানে আসে ইসলামি শাসনব্যবস্থা। তারপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ। নানা সময় নিষেধাজ্ঞা, যুদ্ধের হুমকি ও পরোক্ষ সংঘাত চলেছে। ২০১৫ সালে একটি চুক্তি হয়- ঔঈচঙঅ। এর মাধ্যমে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচিতে নিয়ন্ত্রণ আনবে, আর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। শুরুতে কিছুটা সাফল্য দেখা গেলেও ২০১৮ সালে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে সরে আসেন। তিনি আবারও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর জবাবে ইরান ধীরে ধীরে চুক্তির শর্ত ভাঙতে থাকে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ বাড়ায়, পর্যবেক্ষকদের বাধা দেয়। এখন ইরান এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে তারা অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম উৎপাদনের খুব কাছাকাছি। এমন সময় আবারও আলোচনার চেষ্টা চলছে। চমকপ্রদ বিষয় হলো- ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই আবার চিঠি পাঠিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতার কাছে। তাতে আলোচনার প্রস্তাব ছিল, আবার এক ধরনের হুমকিও ছিল- আলোচনায় ব্যর্থ হলে এর ফল ভালো হবে না। ইরান প্রথমে এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও পরে রাজি হয়। এখন রোমে দুই দেশের প্রতিনিধিরা আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন, যদিও তারা মুখোমুখি নয়। এই আলোচনা এমন সময় হচ্ছে, যখন গোটা মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত। গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, হিজবুল্লাহ ও ইরাকের মিলিশিয়াদের তৎপরতা এবং পারস্য উপসাগরে উত্তেজনা- সব মিলিয়ে পরিবেশ অনেক স্পর্শকাতর। ইসরায়েল বারবার বলেছে, তারা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেবে না। প্রয়োজনে একা হামলা চালাবে। এমন হামলা হলে পুরো অঞ্চলেই বড় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
অন্যদিকে, ইরান নিজের দেশেও নানা সংকটে আছে। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, বিক্ষোভণ্ড সব মিলিয়ে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। তাই তারা একদিকে চায় নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি, অন্যদিকে চায় নিজের অবস্থান শক্ত রাখা। তবে ইরানের একটা বড় দাবি রয়েছে- যদি আবার কোনো চুক্তি হয়, যুক্তরাষ্ট্র যেন পরবর্তীতে তা ভেঙে না দেয়। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া কঠিন। কারণ দেশটির রাজনীতি ভীষণ বিভক্ত। আগামী নির্বাচন সামনে। ফলে তারা এখনই বড় কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চাইছে না। এই পরিস্থিতিতে ওমান ও রাশিয়া মধ্যস্থতা করছে। ওমান অতীতেও এই ভূমিকা নিয়েছে। রাশিয়া, যদিও নিজেরাই পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত, তবুও চায় না আরেকটা যুদ্ধ শুরু হোক। সব মিলিয়ে, যুদ্ধ এখনো অবশ্যম্ভাবী নয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা বাড়ছে। কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা উসকানি যদি ঘটে, তাহলে বড় সংঘাত শুরু হতে পারে। তবুও একটুকু আশার জায়গা আছে। দুই পক্ষই জানে- যুদ্ধ মানে ভয়ানক ক্ষতি। ইরান চায় না আরও অবরোধ। যুক্তরাষ্ট্রও চায় না নতুন যুদ্ধের ঝামেলা। কিন্তু এই আলোচনার পথ খুব সংকীর্ণ। আস্থা নেই, পরস্পরের ওপর বিশ্বাস নেই। কূটনীতি এখন জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে। এই মুহূর্তে বিশ্ব যেন দাঁড়িয়ে আছে এক পুরোনো চেনা মোড়ের সামনে। অতীতে আমরা দেখেছি- যেখানে কথা বন্ধ হয়, সেখানে গোলা-বারুদের ভাষা শুরু হয়। তাই আলোচনার এই সুযোগকে কাজে লাগানো জরুরি। নেতারা যদি দূরদর্শিতা দেখাতে পারেন, তাহলে হয়তো এই উত্তেজনার আগুন নেভানো সম্ভব। না হলে ইতিহাস আবারও আমাদের কড়া মূল্য চুকাতে বাধ্য করবে।
বাংলাদেশের ঝুঁকি : করোনার ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ব অর্থনীতি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধও চলছে চার বছর ধরে। এই প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সম্ভাব্য যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতির উপর নতুন করে এক বড় চাপ সৃষ্টি করবে। এর প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশে এসে পড়বে- বিশেষ করে আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও প্রবাসী আয়ের উপর। বাংলাদেশের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্ক শুধু কূটনৈতিক নয়, বরং অনেকটাই অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতায় গাঁথা। আমাদের মোট প্রবাসী আয়ের প্রায় ৬৫ শতাংশ আসে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার ও ওমানসহ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই টাকা দিয়ে দেশের লাখ লাখ পরিবার চলে, গ্রামে-গঞ্জে অর্থনীতি সচল থাকে, এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গঠিত হয়। এই উপার্জন থেমে গেলে শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয়- পুরো দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
একইভাবে, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। আমাদের প্রয়োজনীয় জ্বালানির ৮০ শতাংশের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকেই। বিশেষ করে, ইরান ও সৌদি আরব সংলগ্ন হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৩৩ শতাংশ অপরিশোধিত তেল পরিবাহিত হয়। এই পথ যদি কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায় কিংবা সামরিক উত্তেজনার কারণে ব্যাহত হয়, তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বিপুল হারে বেড়ে যাবে। এরইমধ্যে জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের বার্ষিক ব্যয় প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে এই খরচ দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। এর প্রভাব সরাসরি পড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন খরচ ও শিল্প খাতে। সাধারণ জনগণের জন্য খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাবে। এরইমধ্যে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। আরেকটি জ্বালানি সংকট এই হারকে দ্বিগুণে পৌঁছে দিতে পারে। বিষয়টি শুধু জ্বালানি বা প্রবাসী আয়ে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের বাকি অংশও এখন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শুল্কযুদ্ধ ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা এবং সব মিলিয়ে বিশ্ববাজারে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও সংকুচিত করবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত- বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে, যেখান থেকে আমরা প্রতিবছর ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করি এবং যেখানে ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন। অর্ডার বাতিল, কাঁচামালের সংকট এবং বৈশ্বিক বাজারে চাহিদার ঘাটতি- সব মিলিয়ে পোশাক খাতকে নতুন করে টিকে থাকার লড়াইয়ে নামতে হবে। এই খাত যেভাবে মহামারি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, সেই প্রচেষ্টা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এক রাতেই, যদি বৈশ্বিক অর্থনীতি আবার মন্দার দিকে যায়। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারেও এর প্রভাব পড়বে। রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে, বৈদেশিক ঋণ নেয়ার প্রয়োজন বাড়বে, যা পরবর্তীতে কড়াকড়ি শর্ত ও অর্থনৈতিক সংস্কার চাপ তৈরি করবে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় কমাতে হতে পারে, বাড়তে পারে জ্বালানি ভর্তুকির বোঝা। এসব সংকটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রবাসী শ্রমিকরা। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৬.৫ মিলিয়ন (৬৫ লাখ) কর্মী অবস্থান করছেন। যুদ্ধ বা রাজনৈতিক অস্থিরতায় এদের অনেকে কাজ হারাবেন, ফেরত আসবেন খালি হাতে, কিংবা সেখানে আটকে পড়বেন অনিশ্চয়তার মধ্যে। ১৯৯০-এর দশকের ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় যেভাবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের হঠাৎ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, এবারও সেই চিত্র ফিরে আসতে পারে।
ফলে প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? : যুদ্ধ তো আমরা থামাতে পারব না, কিন্তু তার প্রভাব থেকে দেশকে কিছুটা রক্ষা করার উদ্যোগ তো আমাদের নিতে হবে। এখন সময় পরিকল্পনার, সতর্কতার ও বিচক্ষণতার। প্রথমত, আমাদের শ্রমবাজার বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে। বারবার সৌদি আরব বা ওমানের দিকে তাকিয়ে থাকার দিন শেষ। মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, এমনকি পূর্ব ইউরোপেও নতুন বাজার খোঁজা উচিত। দক্ষতা উন্নয়ন, ভাষা প্রশিক্ষণ এবং পেশাভিত্তিক শিক্ষা বাড়ালে বাংলাদেশের শ্রমিকরা এসব বাজারে প্রবেশ করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, জ্বালানি নিরাপত্তায় কৌশলগত পরিবর্তন প্রয়োজন। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে (সৌর, বায়ু, হাইব্রিড) বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় জ্বালানির একটি অংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি স্ট্র্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারি প্রস্তুতি থাকতে হবে। প্রবাসী আয় কমে গেলে কোন খাতে কতটা ভর্তুকি দিতে হবে, কোন খাতে প্রণোদনা প্রয়োজন হবে, রপ্তানি খাতকে কীভাবে সাপোর্ট দেওয়া যাবে- এসব প্রশ্নের উত্তর এখন থেকেই প্রস্তুত রাখতে হবে। চতুর্থত, কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করা উচিত। বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলে। এই অবস্থান থেকেই আমাদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির পক্ষে সোচ্চার হতে হবে। ওআইসি, জাতিসংঘ ও নন-অ্যালায়নড মুভমেন্টে আমাদের ভূমিকা আরও দৃঢ় হওয়া দরকার। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আত্মতুষ্টি ও নির্লিপ্ততা পরিহার করা। আমরা ভাবতে পারি, যুদ্ধ তো অনেক দূরে হচ্ছে, আমাদের কিছু হবে না। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে কোনো অঞ্চলই আসলে ‘দূরে’ নয়।
অর্থনীতি, জ্বালানি, বাজার- সবই আজ আন্তঃনির্ভরশীল। এক প্রান্তে আগুন লাগলে অন্য প্রান্তে ধোঁয়া উঠবেই। বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু আমাদের এই এগিয়ে চলা টেকসই করার জন্য প্রয়োজন দূরদৃষ্টি, প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা। বিশ্ব এখন একটি নতুন ক্রান্তিকালে প্রবেশ করেছে- যেখানে শক্তির ভারসাম্য বদলাচ্ছে, অর্থনীতি অস্থির, আর ভূরাজনীতির রূপ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের মধ্যেই টিকে থাকতে হবে বাংলাদেশকে। পারস্য উপসাগরে যুদ্ধের উত্তাপ হয়তো আজ টিভির স্ক্রিনে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই আগুন যে ঢাকার বাজারে, চিলাহাটি সীমান্তে, বা চট্টগ্রামের বন্দরে গিয়ে পৌঁছাবে, তা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়াটাই এখন জরুরি। যুদ্ধ আমাদের বানানো নয়, কিন্তু তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এখনই সময় সচেতনতার, উদ্যোগের, এবং ঐক্যের।
কলাম লেখক