চট্টগ্রামের সবচেয়ে বৃহৎ বৈশাখি ও লোকসংস্কৃতি মেলা হচ্ছে জব্বার মিয়ার বলীখেলা। বলীখেলা জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে চট্টগ্রামে বিবেচিত। বলীর রাজ্য হিসেবে পরিচিত ‘চট্টগ্রাম’। জব্বারের বলীখেলা সেই নামেরই প্রমাণ বহন করে চলেছে আজও। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তিকে বলী বলা হয়। জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা এ জেলার লালদীঘি ময়দানে প্রতি বছর ১২ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়। এই খেলায় অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় ‘বলী’। আব্দুল জব্বার সওদাগরের ছেলের ঘরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিনি তার বাবার মুখে শুনেছেন খেলাটা কিছুটা প্রচলন হওয়ার পর বলীরা সেই সময় মাস দু’য়েক আগে এসে জড়ো হতেন। তাদের বাড়িতেই বড় একটা বৈঠকখানা ছিল। সেই ঘরেই থাকতেন। সেখানেই তারা খাওয়াদাওয়া করতেন এবং দিনভর নানা শারীরিক কসরত ও অনুশীলন করতেন, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন লেখাপড়া করি তখন দেখতাম চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা- নোয়াখালী, কুমিল্লা এসব জায়গা থেকেও বলীরা আসতে শুরু করল। এরপর সারা দেশ থেকে আসতে শুরু করে। এমনকি একবার আমার মনে আছে, ফ্রান্স থেকে দুজন কুস্তিগীর এখানে অংশগ্রহণ করেছিল।’
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বিপুল সম্ভার নিয়ে প্রতি বছর চট্টগ্রাম শহরে আয়োজিত জব্বার মিয়ার বলীখেলা দেশীয় ঐতিহ্যের বড় আয়োজন। যখন ডিশ, স্যাটেলাইট, স্মার্ট ফোন ছিল না তখন গ্রামের মানুষের বিনোদনের একটা জায়গা ছিল এই বলীখেলা। শৈশব থেকেই জব্বারের বলীখেলার পাশাপাশি ডিসি সাহেবের বলীখেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলীখেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলীখেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলীখেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলীখেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলীখেলার নাম শুনে আসছি। বিগত কয়েক বছর ধরে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি’র শিরিষ তলায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল সাহাবউদ্দিনের বলীখেলা। জব্বার মিয়ার বলীখেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। ঐতিহাসিক জব্বারের বলীখলা আগামী ১২ বৈশাখ, ২৫ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘী ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে। ১১৫তম জব্বারের বলীখেলা উপলক্ষে ২৪, ২৫ এবং ২৬ এপ্রিল তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে জমজমাট বৈশাখি মেলা। প্রতি বছর জব্বার মিয়ার বলীখেলায় যাওয়ার জন্য চেষ্টা করি। লোক ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক চট্টগ্রামের জব্বার মিয়ার বলীখেলা।
বলীখেলা আমাদের লোকক্রীড়াগুলোর মধ্যে ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি খেলা। বলীখেলা মানে কুস্তি প্রতিযোগিতা। জব্বারের বলীখেলার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তিকে বলীখেলা নামে ডাকা হয়। বলীখেলাকে ঘিরে লালদীঘি মাঠের আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকে বৈশাখি মেলার আয়োজন।
১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এই প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। তার মৃত্যুর পর প্রতিযোগিতাটি জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রতি বছরের ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় জব্বারের বলীখেলা। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘি মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন ব্যবসায়ী জব্বার সওদাগর। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামি-দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।
লোকসাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশে বলীখেলা শুধু চাটগাঁইয়াদের। চট্টগ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতিও বটে। এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা। বলী শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো শক্তিশালী বা পরাক্রমশালী লোক, বীরপুরুষ, শক্তসামর্থ্য। অর্থ শুনে বোঝা যায়, বলীখেলা মানে শক্তিশালীর মল্লযুদ্ধ বা কুস্তি প্রতিযোগিতা। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের ১৯টি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী, সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরত প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলীখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলীখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ২২টি মল্ল পরিবারের কথা পাওয়া যায় ইতিহাসবিদ আবদুল হক চৌধুরীর ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ (পৃ. ২৪৪) বইয়ে। যেমন- আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরির চিকন মল্ল, কাতারিয়ার চান্দ মল্ল, জিরির ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারির হরি মল্ল, পেরলার নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওয়ের অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদ-ীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল। তবে পূর্বপুরুষের পেশা থেকে সরে গেছেন অনেক মল্ল।
ধান কাটা শেষ হলে চৈত্র ও বৈশাখে গ্রাম-গঞ্জে বলীখেলার ধুম পড়ত। খোলা মাঠ, দিঘীর পাড় কিংবা ফসলের শুকনো মাঠে খেলার আয়োজন হতো। হাঁটবাজার, পাড়া-মহল্লায় বংশীবাদকরা সাড়া জাগাত। সানাই-ঢোল পিটিয়ে সমগ্র মহল্লায় এলান করা হতো। যে গ্রামে খেলা হতো তার বাইরেও পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামে খবর হয়ে যেত। মাঠের চারপাশ ছেয়ে যেত রংবেরঙের পতাকায় আর খেলার দিন সকাল থেকেই দর্শকদের আনাগোনায় মুখরিত হতো অনুষ্ঠানস্থল। রোমান সাম্রাজ্যে প্রচলিত ঘুষাঘুষি ও রক্তারক্তির পাশবিক চিত্তবিনোদন এখানে পরিত্যাজ্য। হাত-পায়ের কসরতে অপর বলীকে ঘায়েল করাটাই এখানে মূখ্য। শক্তি খাটিয়ে প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলে দিয়ে পিঠ ঠেকাতে পারলেই কেউ একজন বিজয়ী নির্বাচিত হন।
খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচণ্ডছয় দিনের মেলা বসে। লালদীঘি ময়দানের আশপাশের এলাকা ঘিরে চারিদিকে জমজমাট আসর থাকে। সারা বছর চট্টগ্রামের মানুষ অপেক্ষার প্রহর গোনে এ মেলার জন্য। এখানে যেমন পাওয়া যায় ঘর সাজাবার উপকরণ, তেমনি আছে নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী। আরও আছে মুড়ি মুড়কি, লাড্ডুর মতো রসনা তৃপ্তির নানা উপকরণও। লালদীঘি ময়দান থেকে আন্দরকিল্লা, সিনেমাপ্যালেস, কোতোয়ালি মোড় পর্যন্ত দোকানিদের অনেকেই পছন্দের জায়গা নিয়ে বসে যান পসরা নিয়ে।
এই মেলায় সিলেট বিভিন্ন ধরণের শীতল পাটি আসে।
বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যগত কুটির শিল্প। মুর্তা বা পাটি বেত বা মোস্তাক নামক গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছাল থেকে এগুলো তৈরি হয়ে থাকে। হস্তশিল্প হিসাবে এগুলোর যথেষ্ট কদর রয়েছে। শহরে শো-পিস এবং গ্রামে এটি মাদুর ও চাদরের পরিবর্তে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সাজসজ্জা দ্বারা সজ্জিত মাদুরকে নকশি পাটিও বলা হয়। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতল পাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
গরম থেকে রক্ষা পেতে যেমন বিক্রি হয় হাতপাখা। আরও থাকে চুড়ি ফিতা, রঙিন সূতা, হাতের কাঁকন, নাকের নোলক, মাটির ব্যাংক, ঝাড়ু, খেলনা, ঢোল, বাঁশি, বাঁশ ও বেতের নানা তৈজসপত্র, কাঠের পুতুল, নকশী কাঁথা, খাঁচার পাখি ইত্যাদি। বিবাহিত মেয়েরা বাবার ঘরে নাইওর আসে। ফিরে যাওয়ার সময় সেখান থেকে সৌজন্যতা করে বেয়াইবাড়িতে পাঠানো হয় মেলার খাবারদাবার। ছোট ছেলে মেয়েরা বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরে মাটির খেলনা, বাঁশি ইত্যাদি কিনে দেওয়ার জন্য। অনেক শিশু আবার নাড়ু, মুড়ি-মুড়কি, মুরালি ইত্যাদি খাওয়ার জন্য টাকা জমায়। মৌসুমি ফল থেকে শুরু করে সব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস মেলা উপলক্ষেই পাওয়া যায়। বেতের তৈরি জিনিসপত্রের বেশ চাহিদা আছে। জব্বার মিয়ায় বলীখেলার আকর্ষণীয় জিনিসপত্রের মধ্য বেতের তৈরি সামগ্রী অন্যতম। বেতের শোপিস আর আসবাবপত্র আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। গ্রামে বা শহরে সব জায়গাতেই বেতের তৈরি পণ্যের চাহিদা রয়েছে বেশ। গ্রামে ঝুড়ি, টুকরি, চালনি, পলো ইত্যাদির ব্যবহার বেশি, অন্যদিকে শহরে সৌখিন পণ্য যেমন- সোফা, চেয়ার, দোলনা, আয়না, বুক সেলফ, ফুলদানি, ওয়ালম্যাট ইত্যাদির ব্যবহার বেশি দেখা যায়। বর্তমানে বেতের ল্যাম্প, ম্যাট, টব, ফুলদানি, ট্রে, কোস্টার, ঝুড়ি বেশ জনপ্রিয়। বলীখেলা থেকে অনেকে বেতের এই সব জিনিসপত্র সংগ্রহ করে থাকেন।
ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা জেএম সেন এভিনিউ থেকে কোতোয়ালি থানা পর্যন্ত এই মেলার পরিধি। এই মেলার বড় একটি আকর্ষণ মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্রের বিচিত্র সমাহার। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক বিক্রেতা বিভিন্নরকম জিনিস নিয়ে শহরে হাজির হন। প্রাচীনকাল থেকে বংশনুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। অতীতে গ্রামের সুনিপুন কারিগরের হাতে তৈরি মাটির জিনিসের কদর ছিলো অনেকাংশ বেশী। পরিবেশ বান্ধব এ শিল্প শোভা পেত গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে। আধুনিকতার ছোয়া লেগে আজ তা হারিয়ে যেতে বসেছে। মাটির তৈরি কলসি, ফুলের টব, সরা, বাসন, সাজের হাঁড়ি, মাটির ব্যাংক, শিশুদের বিভিন্ন খেলনাসমগ্রী নানা ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করত কুমাররা। প্রয়োজনের তাগিদে এবং শখের বশে অনেকেই ভিড় জমান কুমারদের দোকানে। চাহিদার একটি বড় জায়গা দখল করে আছে মাটির ফলকে আঁচড় কেটে তৈরি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন ফকিরের প্রতিকৃতি। এই বলীখেলা উপলক্ষে আয়োজিত বৈশাখি মেলায় বিভিন্ন ধরনের মাটির জিনিসপত্রের সমাহার সত্যি প্রশংসনীয়। সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে অনেকে জব্বারের বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখি মেলা হিসেবেও চিনে। জব্বার মিয়ার বলীখেলা ও বৈশাখি মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই মেলা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলুক।
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট