ঢাকা সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাজার নিয়ন্ত্রণে আইনের বাস্তবায়ন ও জনগণের প্রত্যাশা

মো. জাহারুল ইসলাম
বাজার নিয়ন্ত্রণে আইনের বাস্তবায়ন ও জনগণের প্রত্যাশা

একটি নিয়ন্ত্রিত বাজার হলো এমন একটি বাজার যেখানে সরকারি সংস্থা বা কম সাধারণভাবে শিল্প বা শ্রমিক গোষ্ঠী, এক ধরনের তত্ত্বাবধান এবং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে। বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রায়শই সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বাজারে কারা প্রবেশ করতে পারে এবং তারা কী দাম নিতে পারে তা নির্ধারণ করে। বাংলাদেশে যে কয়টি উদ্ধারহীন সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে একটি হলো দ্রব্যমূল্য। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরা, উৎসব লাগে না এদেশের পান থেকে চুন খসলেই দামটা আকাশে চড়ে বসে। কারণ বা যুক্তি লাগে না অজুহাত পেলেই দামের পারদটা উপরে উঠে যায়। দেশীয় ব্যবসায়ী, আরদারা এতটাই সংঘবদ্ধ যে, তারা চাহিবামাত্র নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন ধরে যায়। তৈরি হয় কৃত্রিম সংকট, তাদের ইশারায় লাটে ওঠে মানুষের জীবন। তাদের অঙুলি হেলনে দুই মুঠো জোটতেই মানুষের জান যায় যায় অবস্থা। দামের পাগলা ঘোড়ার লাগাম যে, সিংহভাগ ব্যবসায়ীদের হাতে তা ব্যবসায়ী নেতারা কখনও স্বীকার করেননি। এ তথ্য সরকারি গবেষণাতেও উঠে এসেছে।

চাল, আলু, আর পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) বলেছে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে দাম বেড়েছে। বিআরসি উপস্থাপিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সবকারের হাতে পর্যাপ্ত মজুদ ছিল না। ছিল মিলারের হাতে ফলে তারা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী চাল ছাড়েনি, সরকারের হাতে যদি চাল থাকত তবে ওএসএমের মাধ্যমে যে বাজারে ছেড়ে নির্ধারণ করা যেত। আলুর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা; এটা সরকারের হাতে থাকে না, থাকে ব্যবসায়ীদের হাতে। বন্যার কারণে যখন সবজির উৎপাদন ব্যবহৃত হয় তখন আলুর উপর চাপ পড়ে। আলুর চাহিদা যখন বেড়ে যায়, তখন কোল্ড স্টোরেজ থেকে কোনো আলু বাজারে ছাড়া হয়নি অথচ সারে তিন লাখ টন আলু আমাদের হাতে রয়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে আলু বাজার ছাড়তে পারেনি। পেঁয়াজের ক্ষেত্রের আমাদের ঘাটতি রয়েছে। ভারত রাস্তা বন্ধ করায় পেঁয়াজের সংকট সৃষ্টি হয়। সেটি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে।

বাজার সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকছে না। কখনও ডিম, কখনও পেঁয়াজ, আলু, সবজি কিংবা কখনও মাছ-মুরগির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভোক্তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের বাজারের হাল দেখে এটিই স্পষ্ট হয় যে, বাজারের ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু বাজারে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে একেকটি নিত্যপণ্যের দাম। সব শ্রেণি-পেশার মানুষই নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশাহারা। কোনো কোনো পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গত সেপ্টেম্বর মাসের বাজারদর ও রাজধানীর খুচরা বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে অনেক পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।

বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মোটেই সংগঠিত নয়। এর সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এখন বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের জীবনে বেশ চাপ সৃষ্টি করছে। দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম না কমাকে দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবেই দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, এর অন্যতম কারণ হলো বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব। বাজার সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেখার বিষয়, দেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত কি না। সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো কি সন্তোষজনক? বাজারে কি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা আছে? মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারের যেসব বিভাগ ও সংস্থা রয়েছে, তাদের কার্যক্রম নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যেন বাজারকে অস্থির করতে না পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। আমদানি ঠিক রেখে সাপ্লাই চেইন সচল রাখার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

অন্তর্বর্তী সরকার শুল্কছাড় ও আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়ার মতো কিছু সুবিধা দিলেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। কঠোরভাবে বাজার মনিটরিংয়ে প্রতি জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের সীমিত জনবল নিয়ে বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে, কিন্তু এই অভিযানেরও বাজারে কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজার সাধারণের নাগালের মধ্যে আসবে-এটিই আমাদের প্রত্যাশা। ভোগ্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট আছে-সব সময় বলা হয়। কিন্তু কোথায় কীভাবে সিন্ডিকেট হয় সে ব্যাপারে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তেমন কোনো তথ্য ছিল না বা থাকলেও সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা হতো না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গত আড়াই মাসের মেয়াদে বাজারে অভিযান বেশ জোরদার করা হয়। এসব অভিযানে কোন পণ্যে কোথায় সিন্ডিকেট বা কারসাজি হচ্ছে তা অনেকটাই দৃশ্যমান হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযানেও তথ্য মিলেছে ভোগ্যপণ্যের বাজারে ধাপে ধাপে সিন্ডিকেট রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, একেক পণ্যে সিন্ডিকেট হয় একেকভাবে। যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান বাজার তদারকি করছে তাদের পর্যালোচনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ভোগ্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষের পকেট খালি করলেও সরকার ছিল নির্বিকার। এ কারণে বাজার আরও বেসামাল হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্যের বাজারের এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চাইছিল। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রত্যাশা ছিল এবার হয়তো ভাঙবে বাজার সিন্ডিকেট, কমবে ভোগ্যপণ্যের দাম। বর্তমান সরকারের সাত মাস পার হয়ে গেলেও দেশের সাধারণ মানুষের সে আশা পূরণ হয়নি বরং ডিম, সবজি, মাছ-মাংস, চালসহ অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে গেছে। এতে ক্ষোভ বাড়ছিল ভোক্তাদের। বর্তমান সরকার দাম কমাতে বেশকিছু পণ্যের শুল্ক ছাড়সহ আরও কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে, তাতেও যখন কাজ হচ্ছিল না- সরকার বাজার অভিযান জোরদার করে। একসঙ্গে মাঠে নামায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তিন উপ-সচিবের নেতৃত্বে তিনটি টিম।

লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত