প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ৪৩৩টি সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন পেশ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন। কমিশন তার দায়িত্ব যথাসময়ে সম্পন্ন করেছে, এজন্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য; কিন্তু বেশ কিছু সুপারিশের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কমিশনের সুপারিশে জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করা এবং তাতে নারীদের জন্য ৩০০ আসন সংরক্ষণ, বিয়ে-তালাক ও উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমান অধিকার, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন মিলনকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা; মৃত্যুদণ্ড বিলোপ, পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া, সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি দেয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। নারী অধিকারের বিষয়টি সবসময় অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এর সঙ্গে আমাদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও সামাজিক-পারিবারিক ঐতিহ্য জড়িত। সেই পাকিস্তান আমল থেকে এ নিয়ে সমাজে একধরনের টানাপোড়েন চলছে। বর্তমান কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশ নিয়েও তাই স্বাভাবিকভাবে বিতর্ক উঠেছে। ইসলামী আদর্শের অনুসারী সমাজের একটি বড় অংশ এর মধ্যে এসব সুপারিশ বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে।
কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক, যিনি নারীপক্ষ নামের একটি কথিত প্রগতিশীল বেসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, তিনি বলেছেন, জুলাইয়ে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মরণে এমন কিছু করতে চেয়েছি যা মানুষের ও সমাজের জন্য কল্যাণকর হবে। আমরা জানি, সুপারিশগুলো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হবে, আমরা সেই বিতর্ককে স্বাগত জানাই। আমরা চাই এগুলো নিয়ে আলোচনা হোক।
স্পষ্টতই, কমিশন জেনে বুঝে একটি সামাজিক বিতর্ক উসকে দিতে চেয়েছে, যা কোনোভাবে কাঙ্ক্ষিত নয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহিদরা বৈষম্যবিহীন সমাজ চেয়েছেন, তারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনুসৃত ধর্মীয় আদর্শের বিপরীত দর্শনভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য জীবন উৎসর্গ করেননি।
কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। যে সুপারিশ সম্পূর্ণ আমার ধর্মীয় আদর্শের বিপক্ষে যায় সেটি নিয়ে আলোচনা বা বিতর্কের অবকাশ কোথায়! সে জন্য ইসলামী রাজনৈতিক ও সামাজিক মহল থেকে সুপারিশগুলো বাতিলের দাবি উঠেছে। আমাদের জনগণের ৯০ শতাংশের বেশি মুসলিম। তাদের অনেকে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্ররিপালনে কট্টর না হলেও আশা-আকাঙ্ক্ষা কোনোভাবে ধর্মের প্রতিকূলে নয়; বরং সম্পূর্ণ অনুকূল। এমন একটি সমাজে বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকারে নারীকে সমান অধিকার দেয়ার প্রস্তাব কতটা বাস্তবসঙ্গত, সে প্রশ্ন থেকে যায়।
আরও প্রশ্ন আছে। কমিশনে ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে বিজ্ঞ কোনো সদস্য রাখা হয়নি। সেটি হলে কমিশনের বৈঠকে বিতর্কগুলো সেরে নেয়া যেত। রাষ্ট্রীয় কোনো কমিশন সামাজিক বাস্তবতা পুরোপুরি উপেক্ষা করে সুপারিশ প্রণয়ন করবে- বর্তমান স্বৈরাচারমুক্ত সময়ে তা কোনোভাবে প্রত্যাশিত ছিল না। পতিত স্বৈচারারের সময়ে নারী নির্যাতনবিরোধী এমন কিছু আইন করা হয় যা পুরুষের জন্য চরম বৈষম্যের কারণ হয়েছে। নারী নির্যাতনের মিথ্যা মামলায় হাজারো পুরুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে। আদালতেও তারা কোনো প্রতিকার পান না। স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে ইচ্ছা-অনিচ্ছার ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্র ঘটে। এটি অপরাধ বলে গণ্য করলে পারিবারিক জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
নারীর প্রতি সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও যথাযথ সংবেদনশীল আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির সুপারিশ করেছে কমিশন। এটি জরুরি। এ ক্ষেত্রেও কিন্তু ইসলামের কাছে যেতে হবে। ইসলামে নারীর যে মর্যাদা তা আর কোথাও আছে বলে আমরা মনে করি না।