১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নামে নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা করেন শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। আধিপত্যবাদের বিভীষিকা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বিএনপি গঠিত হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় লক্ষ্য অর্জনের জনগণের আস্থার ঠিকানা হয়েছিল। নতুন এই রাজনৈতিক দলের কারণ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর যখন বাংলাদেশের তৎকালীন সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ও জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই নির্বাচনে নতুন দল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে ২০৭টি আসন পেয়ে বিএনপি প্রথম সরকার গঠন করে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ (মালেক) ৩৯টি আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হয়।
১৫ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েই, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পূর্ণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেবের দেশ ও জনগণের উন্নয়নের চিন্তা, চেতনায় বহির্বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন, শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেব যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দল গঠন করেছিলেন, সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জলন্ত অগ্নিশিখা ওনার ভেতরে দেখেছেন তখনকার বাংলাদেশের জনগণসহ সুশীল সমাজ। তাই তো অল্প সময়ে বাংলাদেশের বুকে বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর শক্ত ভিত্তি করতে তেমন একটি বেগ পেতে হয়নি। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সততা, উদ্দেশ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব মেধা ও চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ হয়ে মানুষ দলে দলে বিএনপিতে যোগ দিতে শুরু করে, অল্প সময়ে বাংলাদেশের তৎকালীন সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়, জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তায় একদল হায়েনা ঈর্ষান্বিত হয়ে, ১৯৮১ সালে ৩০ মে ভোরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কিছু বিপদগামী সেনা সদস্য তাকে হত্যার মাধ্যমে, বাংলাদেশের উন্নয়নের জ্বলন্ত এক অগ্নি শিখা নিভিয়ে দেয়।
শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শূন্যতার অভাব স্বাধীনতার এই ৫৩ বছরেও এই দেশ পূরণ করতে পারেনি। জিয়াউর রহমান শহিদ হওয়ার পরবর্তী সময়, জিয়াউর রহমানের আদর্শকে অল্প সময় যারা বুকে লালন করেছিল, তাদের মধ্যেই কিছু শীর্ষ নেতা ও কিছু কর্মীদের দাবির অনুরোধে ১৯৮২ সালে ৩ জানুয়ারি, বেগম খালেদা জিয়া দলের প্রাথমিক সদস্য পদ নিয়ে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অসমাপ্ত কাজগুলোকে সমাপ্ত করতে, জিয়াউর রহমানের আদর্শকে সামনে রেখে গৃহবধূ থেকে রাজনীতির মাঠে আসেন।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা, জিয়াউর রহমানের আদর্শকে এদেশের বুকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, ওনার নেতৃত্বে শুরু হয় স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন, এরশাদের পুরো শাসন আমলে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির রাজনীতি ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন, বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতির মাঠে নেমে ওনার চৌকস বুদ্ধি, দেশাত্মবোধ, সততা ও কর্মীবান্ধবতার কারণে, অতি তাড়াতাড়ি নেতৃত্বের উচ্চ শিখরে পৌঁছে যান। জিয়াউর রহমানের মতো বেগম খালেদা জিয়া জনগণ ও কর্মীদের মনের ভাষা উপলব্ধি করতে পারতেন, তাই তো বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ পতনের আন্দোলনে কর্মী সংকট দূর করে, আপসহীন উত্তাল আন্দোলনের সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান। ছাত্রদল ও যুবদলসহ সব সংগঠনকে অতি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রাজপথে আপসহীনভাবে পরিচালনা করেন এবং আন্দোলনে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, পরিশেষে স্বৈরাচার এরশাদের পতন নিশ্চিত করে; বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ভোটের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরিবেশ করেন। রাজননৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির প্রকৃত বিকাশ ঘটেছে এবং সকল প্রতিকূলতার পথ পার করে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি প্রধান শক্তি হিসেবে, স্বৈরাচার পতনের পরবর্তী নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে, বিএনপি ১৪৪টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে এই দেশে রাষ্ট্রপতি শাসনের অবসান ঘটান, ধাপে ধাপে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি তিনবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে।
১/১১ এরপর আবির্ভাব হলো নতুন স্বৈরাচার, তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আমলে, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ বাংলাদেশের জনগণকে জিম্মি করে, একনায়কতন্ত্র বাকশাল কায়েম করে ভিন্ন মতাদর্শের কোনো এক দেশের তাবেদারি সরকার বানিয়ে রেখেছিল। সব সরকারের ক্ষমতার উৎস দেশের জনগণ, এটি এই তাবেদারি সরকার ভুলে গিয়েছিল, তবে বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচার পতন করেছিলেন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে, কিন্তু স্বৈরাচারের শিকড় রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু এইবার স্বৈরাচারের পতনের ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেল। তা হলো নতুন স্বৈরাচার পতনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার সুযোগ্য উত্তরসূরী, তারুণ্যের উদ্দীপনার উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বৈরাচারীর শিকড়সহ উৎখাত করেছেন। যাতে ভবিষ্যতে আর কোনোদিন স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে, এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে তাবেদারি রাষ্ট্র করার আগে, যাতে নতুন স্বৈরাচারের ইতিহাস পড়ে নেয়, এখন আমার প্রশ্ন হলো, বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার দল পরিচালনার ভেতর দিয়ে, কর্মীদের আস্থার জায়গা তৈরি করে দিয়েছিলেন।
আমার মনে হয়, আমি এই ১৬ বছর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় যেটা উপলব্ধি করেছি, জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার শূন্যতায়, তৃণমূল আর আগের মতো সাংগঠনিকভাবে চাঙ্গা মনোভাব নিয়ে, রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশিদূর যাওয়ার আগেই ঝরে পড়ে যায়। আমার কথা হচ্ছে, তরুণরা একটি দলকে বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে, প্র্যাকটিক্যাল রাজনীতি শিখতে আসে। যে চিন্তা, চেতনা, মনোভাব নিয়ে আমরা দল করতে এসে যখন তৃণমূল নেতৃত্বের অভাব মনে জুড়ে বসে, তখন আর নতুনদের মনোবল থাকে না। একজন সিনিয়র নেতার সান্নিধ্য পেতে হলে, আগে সাংগঠনিক দক্ষতা, সততা ও মেধার যাচাই হতো। আর এখন একজন সিনিয়র নেতার সান্নিধ্য পেতে হলে, নেতার বেতনভুক্ত কর্মচারীর মন জয় করে সান্নিধ্য নিতে হয়। একজন তৃণমূল কর্মীর যখন একজন রাজনৈতিক নেতার কর্মচারীর কাছে ধরাসায়ী হতে হয়, আমার মনে হয়, এটি রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির জন্য চরম অপমানজনক। কারণ ওই নেতাকে, নেতা হতে আগে কর্মীর স্বাদ নিতে হয়েছে, তারপরেই সে নেতার জায়গায় পৌঁছেছে। একজন নেতা হতে হলে, তার কর্মী লাগবে, একটা দল চালাতে গেলে কর্মী লাগবে, কর্মী ছাড়া নেতা ও দল দুইটাই অর্থহীন।
তাই আমার মনে হয়, প্রত্যেক দলের নেতাদের কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধকতা দিয়ে নিয়োগ দেওয়া উচিত বলে মনে করি এবং একজন কর্মীর জন্য একজন নেতার দ্বারা সব সময় উন্মুক্ত থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। একজন নেতার ভূমিকা হবে কর্মী তৈরির কারিগর, দেশ ও জনগণ এবং দলের জন্য আপসহীন নিবেদিত প্রাণ হয়ে, মাঠ থেকে উঠে এসে জনকল্যাণকর কর্মকাণ্ডে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে। মাঠ থেকে অর্জন করা অভিজ্ঞতা নিজেদের নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রমাণ করার সুযোগ পাবে, এটিই একজন কর্মীর মনে প্রাণে চাওয়া। একটি জিনিস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে, নিজস্ব বলয়ের ভেতর আবদ্ধ করে রেখেছিল। আশা করি স্বৈরাচারের দুর্বিষহ পতনের মাধ্যমে এই দেশ আবারও গণতন্ত্রের স্বাদ পাবে।
রাজনৈতিক এই কঠিন হিংস্র সময়কেও কিন্তু সকল বিরোধী দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা দেশ ও জনগণ এবং নিজ দলের স্বার্থে অনিশ্চয়তার ভেতরে, রাজপথে সক্রিয় আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছে। তৃণমূল তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে সফলতার নিশানা ছিনিয়ে এনেছে। সফলতার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কিন্তু অনিশ্চয়তার বেড়াজালের ভেতর পথ চলা ছিল, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটাই সফলতা অর্জন। এই সফলতার প্রশংসার প্রাপ্তি তৃণমূলের কর্মীদের দাবিদার। কিন্তু এখন দেখার বিষয় রাজনৈতিক অঙ্গনে আপসহীন দৃঢ় মনোবল নিয়ে রাজপথ কাঁপানো সেই তৃণমূল কর্মীদের অবস্থান কোথায়? যে বৈষম্য দূর করার আন্দোলনের মাধ্যমে, হাজার হাজার ছাত্র জনতার জীবনের আত্মত্যাগের মাধ্যমে, বাংলাদেশ এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে, এই দেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছে, নতুন স্বাধীন এই দেশে, আন্দোলনে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা তৃণমূল কর্মীদের, রাজনৈতিক অঙ্গনে কতটুকু বৈষম্যহীনভাবে মূল্যায়ন করে? লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আন্দোলনের বিজয়ের পরবর্তী সময়ে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশটা অনেকটাই পাল্টে গেছে। প্রতিটি ইতিহাস রচিত হওয়ার পরবর্তীতে, রাষ্ট্রীয় প্রত্যেকটি সেক্টরে পরিবর্তন হবে এটিই স্বাভাবিক, বিজয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভেদ করে অস্বাভাবিক পরিবর্তন, অবশ্যই দুঃখজনক বলে আমি মনে করি। আমার মতে বিজয়ের পরবর্তীতে নেতৃত্ব দানকারী নেতাদের, রাজনৈতিক মনোভাব পরিবর্তনের মাধ্যমে, সংগঠনের অবকাঠামো গঠনমূলক পরিবেশ তৈরীর মাধ্যমে, মূল্যায়নের বৈষম্যহীন নেতৃত্বে ক্ষেত্র তৈরি করে, তৃণমূল থেকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরীর কারিগর হিসেবে, প্রত্যেক সিনিয়র নেতাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলে, আমার মনে হয়, আগামীতে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নতুন নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশ ও জনগণদের জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই আমি মনে করি নেতার নেতৃত্ব হবে নীর্লোভ, নিরঅহংকার ও কর্মীবান্ধব। কোনো কর্মীকে যেন কোনো নেতার কর্মচারীর কাছে ধরাশায়ী হতে না হয়, এই বিষয়টি জোরালোভাবে নেতাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, একজন রাজনৈতিক কর্মী একজন নেতার রাজপথের সকল আন্দোলন সংগ্রামে সহযোদ্ধা, একজন কর্মী রাজপথে নিঃস্বার্থ ভূমিকা পালন করে। তাই প্রত্যেক সিনিয়র নেতাদের উচিত সাংগঠনিকভাবে কর্মচারীদের ঊর্ধ্বে কর্মীদের মূল্যায়নের মাধ্যমে, তৃণমূলের প্রাণ সঞ্চার ধরে রাখা। তাহলেই কর্মী, নেতা ও দলের ভেতরে গভীর এক নিঃস্বার্থ সম্পর্ক স্থাপন হবে। একজন কর্মীর জন্য মূল্যায়নটাই দল ও নেতার কাছ থেকে একমাত্র চাওয়া। এই চাওয়া পূর্ণতার মাধ্যমে, আমার মনে হয় রাজনীতিক অঙ্গনে, বৈষম্যহীন কর্মীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। যে চিন্তা, চেতনা ও আদর্শ নিয়ে, শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দল গঠন করেছিলেন, যে চিন্তা, চেতনা ও আদর্শকে লক্ষ্য করে, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আপসহীনভাবে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দ্বারা দল পরিচালনা করেছেন, ওনাদের সেই চিন্তা, চেতনা ও লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর একমাত্র উপায় বৈষম্যহীন রাজনৈতিক মাঠের পরিবেশ তৈরি করা।
লেখক: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মোটরচালক দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও কলাম লেখক।