ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বিধবা প্রবীণ নারীর জীবন

হাসান আলী
বিধবা প্রবীণ নারীর জীবন

বয়সের প্রার্থক্য ও স্বাস্থ্যগত কারণে প্রবীণ নারীর স্বামী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগে মারা যায়। ষাট বছর বয়সি নারীর প্রায় অর্ধেকের স্বামী মৃত্যুবরণ করে। সত্তুর বছর বয়সি অধিকাংশ নারীর বৈধব্য বরণ করতে হয়। আমাদের চার পাশে তাকালে বিধবা প্রবীণ নারীর মুখ দেখতে পাই। ষাট বছর বয়সি নারীর বিয়ের সংবাদ পাওয়া খুবই কঠিন বিষয়। অথচ এই বয়সে একজন পুরুষ সঙ্গী খুবই প্রয়োজন। এসব বিধবা প্রবীণদের রয়েছে ৪০-৪৫ বছরের দাম্পত্য যাপনের অভ্যস্ততা। দীর্ঘ সময় ধরে স্বামীর সঙ্গে কাটানোর মধ্য দিয়ে যে জীবনযাপন করেছেন তা হারিয়ে প্রচণ্ড মনোকষ্টে ভোগেন। নারীর সব অভিযোগ সাধারণত তার স্বামীকে নিয়ে।

অভিযুক্ত ব্যক্তিটি যখন পৃথিবীতে অনুপস্থিত তখন তার অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। আমাদের দেশে নারীর হাতে সহায় সম্পদ তেমন একটা থাকে না। কিছু দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর পুরুষ কৌশলগত কারণে নারীর নামে সম্পদ রাখে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। বিপদের সময়ে নারী সেসব সম্পদ নিজের কোনো কাজে লাগাতে পারেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর অল্প কিছু সংখ্যক নারী পেনশন সুবিধা পায়। বেশিরভাগ প্রবীণ নারীর হাতে সহায় সম্পদ তেমন একটা থাকে না। বাপের বাড়ির সহায় সম্পদ কৌশলে ভাইদের হাতে চলে যেতে দেখা যায় অথবা নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিতে হয়। আবার বিক্রীত টাকা-পয়সা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না।

পরিবারের নানা রকমের সংকট নিরসনে খরচ করতে হয়। নিজের স্বর্ণের গহনাগুলো ভাগ-বাটোয়ারা করে দিতে হয় অথবা কে কোন গহনা পাবে তা মরার আগে ঘোষণা দিতে হয়।

এই ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মনোমালিন্য হতে দেখা যায়। বিধবা প্রবীণ যদি আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হন তবে বাপের বাড়ির লোকজনের আনাগোনা বাড়ে। বাপের কুলের কৌশলী আত্মীয়-স্বজনরা ফন্দি ফিকির করে ঝামেলায় ফেলবে অথবা স্বার্থ হাসিলের জন্য চেষ্টা চালাবে। সবাই এমনটা করেন তা নয়, তবে বেশিরভাগই লোভে পড়ে স্বার্থ সিদ্ধি করতে সচেষ্ট থাকে। সামর্থ্যবান বিধবা প্রবীণরা সহায় সম্পদ নিয়ে অনেক সময় ঝুঁকির মুখে পড়ে। তারা ছেলে-মেয়ের সঙ্গে একই বাসায় একই বাড়িতে, একই ধরনের রান্না খেয়ে জীবন যাপনের গতানুগতিক ধারায় হাঁপিয়ে ওঠেন। গ্রামে একটা কথা বলতে শোনা যায়, নিজের ঘর- হেগে ভর, পরের ঘর- থুতুর ডর!!

প্রবীণ নারীরা একসময় সংসারের কর্ত্রী ছিলেন, এখন ছেলে, ছেলে বউয়ের কতৃত্ব, খবরদারি পছন্দ করেন না। জীবনের শেষ দিনগুলোতে মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। ছেলে-মেয়ের সংসারে উপস্থিত হয়ে তাদের যন্ত্রণা দিতে পছন্দ করেন না। আবার এমন কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, প্রবীণরা আর সন্তানের সঙ্গে থাকতে পারেন না।

ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বিধবা প্রবীণ নারীকে নিজ বাসায় বা ফ্ল্যাটে একাকী থাকতে দেখা যায়। কারও কারও ছেলে-মেয়ে কাছাকাছি থাকেন। মাঝে মধ্যে ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনরা আসেন। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে থাকতে চান না কেন? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ছেলে-মেয়েরা সারা দিন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দেখা হলে কমন কিছু কথা বলবে, আম্মু কিছু লাগবে? ওষুধ খেয়েছো? কি খাবে? শপিং করবে? কোথাও যাবে? এসব কথায় প্রবীণ নারীর মন ভরে না। দীর্ঘ জীবনে নানা রকমের অভিজ্ঞতায় টইটুম্বুর। মন খুলে কথা বলবে, প্রাণ খুলে হাসবে, আড্ডা দিবে, দায়-দায়িত্ব পালন করতে হবে না, কারো শাসন, আদেশ উপদেশ পরামর্শের যন্ত্রণা সইতে হবে না।

খাবার টেবিল প্রবীণের জন্য এখন আর তেমন আগ্রহের বিষয় না। এটা খাওয়া যাবে না, ওটা কম খেতে হবে, চিনি লবণ বাদ দিয়ে খেতে হবে। এসব শুনতে শুনতে কান জ্বালাপালা হয়ে গেছে। খাবার টেবিলে কি থাকবে তা প্রবীণরা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারেন। একই লোকের রান্না, একই ধরনের খাবার প্রবীণ নারীর খাবারের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়। এজন্য রুচি পরিবর্তনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কোথাও খাবারের নিমন্ত্রণ থাকলে প্রবীণরা যেতে আগ্রহী হন। যারা কোনো কারণে একটু মোটা হয়েছেন তাদের শরীরের প্রতি ইঙ্গিত করে কোনো মন্তব্য দারুণভাবে আহত করে। কিছু লোকজন আছে কীভাবে মোটা কমানো যায় সেই পরামর্শ দিতে শুরু করে। এ ধরনের বেয়াদব লোক আমাদের আশপাশে হরহামেশাই দেখা যায়। যাদের পায়ের ব্যাথায় হাঁটতে অসুবিধা হয় তাদের কেউ কেউ প্রতিদিন ত্রিশ মিনিট হাঁটার পরামর্শ দেন।

রোগ শয্যায় থাকলে সেবা যত্ন করার মতো দরদী লোকজনের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সুলভ মূল্যে সেবা কর্মী পাওয়া যায় না। বর্তমান সেবা মূল্য পরিশোধ করে সেবা গ্রহণের ক্ষমতা অধিকাংশ প্রবীণের নেই। আবার চড়া দামে কেনা সেবার মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায়। পেশাদার সেবাকর্মী তৈরি হবার কাজ চলছে তখন হয়তো সুলভে মানসম্মত সেবা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। অদক্ষ, অপেশাদার সেবাকর্মী তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যায়। এসব গৃহকর্মীর সেবাই অনেকের কাছে একমাত্র অবলম্বন। গ্রামে বিধবা প্রবীণদের একটি অংশ ছেলের সঙ্গে খায় না কিংবা খাবার সুযোগ থাকে না। তারা আলাদা রান্না করে, আলাদা ঘরে বসবাস করে।

অতি দরিদ্র কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে জীবন ধারণ করে। বেশিরভাগ বিধবা প্রবীণার ঘরবন্দি জীবনযাপন করতে হয়। কোথাও যেতে চাইলে শরীর ভালো থাকে না অথবা নিয়ে যাওয়ার মতো সঙ্গী পাওয়া যায় না। আবার যারা চলাচলে কিছুটা সক্ষম তাদের বাইরে ঘুরে বেড়াবার আর্থিক সামর্থ্য নেই। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম প্রবীণের সংখ্যা অনেক কম। সামর্থ্যবান প্রবীণাদের একটি অংশ টাকা-পয়সা খরচ করতে চায় না বরং ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় সঞ্চয় করে।

অনেক সময় দুষ্টু প্রকৃতির লোকজন নানা রকমের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে নিয়ে যায়। প্রতারকদের মিষ্টি কথায় লোভে পড়ে টাকা-পয়সা, সোনা গহনা পর্যন্ত দিয়ে দেয়। বিধবা প্রবীণাদের একটি অংশ পরিবার পরিজনের বিরুদ্ধে নানা রকমের অভিযোগ তোলেন। অভিযোগের বেশিরভাগই অপমান অবহেলা ও নির্যাতনের।

বিধবা প্রবীণ নারীর শান্তি ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে আমাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের নানা রকমের উদ্যোগ অচিরেই দৃশ্যমান হবে এই আশা করা বেশি কিছু না!

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত