মানুষ জন্মায়, বেড়ে ওঠে, স্বপ্ন দেখে। তারপর সেই স্বপ্নকে ছুঁতে ছুঁতে কেটে যায় পুরো জীবন। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, একটিবারের জন্য হলেও, অধিকাংশ মানুষ থেমে প্রশ্ন করে- এই দীর্ঘ পথচলা কি আদৌ কোথাও পৌঁছেছে? নাকি কেবলই আমরা চলেছি, হেঁটেছি, দৌড়াচ্ছি- একটি অদৃশ্য লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে? জীবনকে আমরা প্রায়শই একটি গন্তব্যমুখী সফরের মতো ভাবি, যেখানে প্রতিটি সাফল্য একেকটি ‘স্টেশন’। কিন্তু আদতে কি তা-ই? এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ যেন একেকজন যাত্রী। কারও হাতে আছে ট্রেনের টিকিট, কেউ উঠেছে ছাদে, কেউ দাঁড়িয়ে জানালার পাশে। কেউ জানে সে কোথায় যাচ্ছে, কেউ জানেই না। কেউ ভাবছে, সামনের স্টেশনেই নামবে, কেউ ভাবছে এই ট্রেন চিরকাল চলুক। কিন্তু ট্রেনটা কোথায় যাচ্ছে, সেটি বোঝার আগে যেন চারপাশটা দেখা দরকার- আমরা চলছি, ঠিক আছে, কিন্তু কোথা থেকে, কোন উদ্দেশ্যে, সেই উত্তর কি আছে কারও কাছে? সমাজ আমাদের শেখায়- জীবনে লক্ষ্য স্থির করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই প্রশ্ন করা হয়, ‘বড় হয়ে কী হতে চাও?’ চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পাইলট- এই সব পরিচিত পেশার বাইরে আর কোনো উত্তর যেন গ্রহণযোগ্য নয়। বাচ্চার স্বপ্ন, কল্পনা, অনুভব- সব কিছুই গন্তব্যের কাঠামোতে ফেলে বিচার করা হয়। ফলাফল, আমরা বড় হই কিছু একটা ‘হয়ে ওঠার’ তাড়নায়। আর সেই তাড়নায় পড়ে জীবনের মুহূর্তগুলো হারিয়ে যায়- ক্লাসের সেই জানালার ধারে বসে দেখা আকাশ, বন্ধুর সঙ্গে লুকিয়ে খাওয়া আইসক্রিম, অথবা প্রথম প্রেমের লজ্জামাখা চিঠি- এসব হয়ে যায় অপ্রাসঙ্গিক।
তবে জীবনের সৌন্দর্য তো এদের মাঝেই লুকিয়ে থাকে। লক্ষ্যপূরণের চাপে আমরা হারিয়ে ফেলি উপলব্ধির ক্ষমতা। মনে থাকে পদোন্নতির হিসেব, মনে থাকে মেয়াদ ফুরোনো ঋণের কিস্তি কিন্তু মনে থাকে না দুপুরের সেই নরম রোদে দাঁড়িয়ে থাকা মুহূর্তটি, যেখানে শুধু নিঃশব্দে বাতাস চলেছে, আর আমাদের মন খানিকটা হালকা হয়ে উঠেছিল। আসলে জীবন মানে অপেক্ষা নয়, জীবন মানে বর্তমান। এখন, এই মুহূর্তেই জীবন ঘটছে। গন্তব্য যদি আসে, ভালো কথা। না এলেও ক্ষতি নেই। পথটাই যদি সুন্দর হয়, তাহলে সে যাত্রা ব্যর্থ হতে পারে না। কিন্তু আমাদের চোখে তো পথের চেয়ে গন্তব্যটাই বড়। আমরা প্রতিদিন অপেক্ষা করি ‘ভালো সময়’-এর জন্য, ছুটি পেলেই একটু আনন্দ করব, রিটায়ার করলে একটু শান্তিতে থাকব, বাড়ি তৈরি হলে আত্মীয়দের ডাকবো- এসব অপেক্ষা করতে করতেই জীবন শেষ হয়ে যায়। জীবন অপেক্ষা করার জন্য নয়, বাঁচার জন্য। আর এখানে আসে একটি গভীর সত্য জীবনের সৌন্দর্য পরিকল্পনার বাইরে। অপ্রত্যাশিত কোনো ভোরে হঠাৎ করে মেঘের আড়াল থেকে সূর্যের মুখ দেখা, রাস্তার পাশে একটা পুরোনো গান বাজতে থাকা, অথবা ব্যস্ত জীবনের ভিড়ে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া- এসবই আমাদের হৃদয়ে দাগ কাটে। কারণ এগুলো পরিকল্পনার অংশ ছিল না, অথচ এগুলোই সবচেয়ে খাঁটি অনুভূতি এনে দেয়। তবে কি জীবন গন্তব্যহীন? হয়তো তাই। কিংবা বলা যায়, জীবন নিজেই গন্তব্য। এই চলমানতাই তার প্রকৃতি। আমাদের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রতিটি ভুল, প্রতিটি অর্জন- সব কিছু মিলেই তো জীবন। তাকে একক কোনো মানদ-ে বিচার করা সম্ভব নয়। জীবন মানে কেবল সাফল্য নয়, কেবল সুখ নয়- জীবন মানে অনুভব, উপলব্ধি, বিরতি, কখনও হতাশা, কখনও বিস্ময়।
তাই যদি একটুখানি থেমে তাকাই নিজের জীবনের দিকে, যদি অনুভব করি বাতাসের স্পর্শ, শব্দের গভীরতা, কারও চোখে লুকানো মায়া- তবে হয়তো বুঝব, জীবন সত্যিই গন্তব্যহীন কিন্তু তাতেই তার মহিমা। এই পথ চলার মাঝেই লুকিয়ে আছে আমাদের সমস্ত অর্থ, সমস্ত গল্প।
জীবনকে তাই লক্ষ্যের কাঠামোতে না বেঁধে, অনুভবের আঙ্গিকে ভাবা দরকার। তবেই সে মুক্ত হবে। তখন সে আর কোনো ‘পরিণতি’র অপেক্ষায় থাকবে না, প্রতিটি মুহূর্তেই জেগে উঠবে এক নতুন অর্থে।
লেখক : শিক্ষার্থী; ঢাকা কলেজ