কয়েক বছর ধরে একটি বিষয় বেশ জোরেশোরে আলোচিত হয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি (লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়া। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার বিষয় দেশের অভ্যন্তরে যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনি আঞ্চলিক এবং কিছু আন্তর্জাতিক মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। সেই হিসেবে আগামী বছর নভেম্বরে বাংলাদেশের এলডিসি মর্যাদা থেকে উত্তরণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। বিষয়টি আগের সরকারের আমলে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি বা অনেক ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জিত করে ইতিবাচকভাবে আলোচিত হয়েছে।
এখন শুরু হয়েছে ঠিক তার বিপরীত চিত্র। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে অতি মাত্রায় নেতিবাচক আলোচনা শুরু করেছেন। বিশেষ করে কয়েকটি পেশাদার সংস্থা থেকে আলোচনা চলছে একেবারেই নেতিবাচকভাবে।
সম্প্রতি একটি গবেষণা সংস্থার এক নির্বাহী পরিচালক জানিয়েছেন যে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বছরে আট বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে।
কিন্তু এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের কী কী লাভ হতে পারে, সে ব্যাপারে তিনি কিছুই উল্লেখ করেননি। সেই অনুষ্ঠানে ডিবেট প্রতিযোগিতার এক কর্ণধার উল্লেখ করেছেন যে আগের সরকারের সব মিথ্যা ও গোঁজামিলের। তার কথায় সত্যতা থাকতে পারে। কিন্তু সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা; যেমন- আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নিজেদের উদ্যোগে যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সরকার প্রদত্ত তথ্যের থেকে কম হলেও কাছাকাছিই ছিল।
এসব আন্তর্জাতিক সংস্থাও কি তাহলে অসত্য তথ্য প্রকাশ করেছে? আগের সরকার মিথ্যা বা গোঁজামিলের তথ্য দিলেও দিতে পারে। কিন্তু সেসব তথ্য তো জাতিসংঘের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে এবং তাদের মাপকাঠিতে তথ্যগুলোর সত্যতা নিরূপণের পরই একটি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের সুযোগ পাবে। সব দেশের ক্ষেত্রেই এ রকম হয়। জাতিসংঘের মতো সংস্থা যে সরকার প্রদত্ত মিথ্যা ও গোঁজামিলের তথ্য গ্রহণ করে, তা আমাদের আগে জানা ছিল না। এই প্রথম জানলাম।
বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশল কী, তা এখনও স্পষ্ট করে জানা যায়নি। বর্তমান সরকার কি আগামী বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাবে, নাকি পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। অবশ্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি ভালো দিক হচ্ছে, তারা অর্থনীতি নিয়ে তেমন কোনো মন্তব্যই করেনি। রাজনীতি, নির্বাচনসহ অনেক বিষয়ে তারা বেশ সোচ্চার হলেও দেশের অর্থনীতির ব্যাপারে কোনো রকম মন্তব্য করতে দেখিনি। বিষয়টি তারা অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।
এ কারণেই হয়তো সরকারের কোনো মহল থেকে দেশের অর্থনীতির বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে না। এটি একটি ভালো দিক। কেননা, দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতির স্বার্থে নিরপেক্ষভাবে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন এবং নিচ্ছেনও নিশ্চয়ই।
এ কথা অনস্বীকার্য যে দেশে সরকার পরিবর্তনের পর যে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এই অবস্থা দীর্ঘ হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য নির্ধারিত কিছু সূচক অর্জনে পিছিয়ে পড়তে পারে। সে জন্য হাল ছেড়ে দিয়ে এলডিসি থেকে উত্তরণের পথ থেকে সরে এসে আরো দীর্ঘদিন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে থাকার সিদ্ধান্ত মোটেই ভালো হবে না। অনেক কষ্টে এই স্বল্পোন্নত দেশের দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে আবারো স্বল্পোন্নত দেশের দুষ্টচক্রে আটকে যেতে হবে এবং সেখান থেকে খুব সহজে বের হওয়া সম্ভব হবে না। কিছু সূচক যদি পিছিয়ে গিয়েও থাকে, যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে তা এগিয়ে নেওয়া কঠিন কিছু নয়। প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে গতি নিয়ে আসা।
সবার আগে প্রয়োজন দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা। বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত না হলে অনেক সূচক এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হতে পারলে লাভ হবে, নাকি ক্ষতি হবে, সেটি একটি লম্বা বিতর্ক। যেকোনো অবস্থানের কিছু ভালো দিক যেমন থাকে, তেমনি আছে কিছু খারাপ দিক। স্বল্পোন্নত দেশ থাকার কিছু সুবিধা আছে এবং আছে কিছু অসুবিধাও। তেমনি উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার কারণে যেমন কিছু সুবিধা থাকে, তেমনি আছে কিছু অসুবিধা। তার পরও মানুষ ওপরের দিকে যেতে চায়, উন্নত হতে চায়। এটি ব্যক্তি এবং দেশের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। আমেরিকা ও চীন হচ্ছে বিশ্বের দুটি বড় অর্থনীতির দেশ এবং চীনের অর্থনীতি আমেরিকাকে প্রায় ধরে ফেলেছে।
আমেরিকার অর্থনীতি হচ্ছে ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার এবং চীনের অর্থনীতি হচ্ছে ২০ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু আমেরিকার রাষ্ট্রীয় ঋণ ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ১২৮ শতাংশ। পক্ষান্তরে চীনের রাষ্ট্রীয় ঋণ ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ৮০ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় ঋণের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে চীনের অর্থনীতি আমেরিকাকে এরই মধ্যে ধরেই ফেলেছে। কিন্তু আমেরিকা উন্নত দেশ এবং চীন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ভোগ করে। ফলে অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান; যেমন- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের কার্যক্রমে চীনের তুলনায় আমেরিকা অনেক গুণ বেশি অর্থ প্রদান করে। এ নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চরম ক্ষোভ আছে এবং প্রতিবাদে বার্ষিক চাঁদা হ্রাস বা বন্ধ করার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু কখনোই আমেরিকা উন্নত দেশের স্ট্যাটাস ত্যাগ করে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে নামতে চায় না। একইভাবে বেশি অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে জেনেও চীন উন্নত দেশের মর্যাদা লাভের জন্য চেষ্টা করে চলেছে। এটিই বাস্তবতা এবং এটিই স্বাভাবিক। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমাদেরও এলডিসি থেকে বের হয়ে এসে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে হবে, তাহলেই একদিন মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছার সুযোগ হবে।
এ কথা ঠিক যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে গেলে কিছু সুবিধা হাতছাড়া হয়ে যাবে। যেমন- নামমাত্র সুদে আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ, রপ্তানি কোটা, শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগাগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হবে। শুল্কমুক্ত রপ্তানি বা কোটার অধীনে রপ্তানির পরিমাণ খুবই সীমিত। সাধারণত যেসব দেশের পণ্যের মান খুব বেশি উন্নত নয় এবং যেসব দেশে মানসম্পন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, তাদের কোটা বা শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়, যেমনটি বাংলাদেশ আজ থেকে দুই যুগ আগে ছিল। এখন বাংলাদেশে অনেক মানসম্পন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং প্রচুর উন্নতমানের পণ্যসামগ্রী উৎপন্ন হয়, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভালো জায়গা করে নিতে পারে। সাশ্রয়ী মূল্য, সহজ বিপণন প্রক্রিয়া এবং পণ্যের গুণগত মানের কারণে ভালো বাজার দখল করে নিতে পারবে। প্রয়োজন শুধু যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ এবং ব্যবসায়ীদের কার্যকর নীতি সুবিধা প্রদান করা।
এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে যে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করব, নাকি শুল্কমুক্ত বা কোটার সুবিধা নিয়ে বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করব? উল্লেখ্য, বর্তমান প্রেক্ষাপটে শুল্কমুক্ত রপ্তানির চিন্তা বাদ দিতে হবে। ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী যে শুল্কযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন, তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। ট্রাম্প এরই মধ্যে বাংলাদেশের কিছু পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। একবার শুল্কযুদ্ধ শুরু হলে, তা খুব সহজে স্বাভাবিক হবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই আগামী দিনে শুল্কমুক্ত সুবিধার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আমাদের যে বিশেষ সুবিধা আছে; যেমন- স্বল্প মূল্যে মানসম্পন্ন পণ্য, সেটিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই নিজেদের জায়গা করে নিতে হবে। এটি করতে হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
একইভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে থেকে আইএমএফ, এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থা থেকে ১ শতাংশ সুদে ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করব, নাকি সেখান থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে ৩-৪ শতাংশ সুদে ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ গ্রহণ করব? দ্বিতীয় পর্যায়ের সুবিধা নিতে হলে অবশ্যই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে এসে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাতে হবে।
স্বল্পোন্নত দেশের প্রতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের দৃষ্টি থাকে দয়া এবং করুণার মতো। পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল দেশের প্রতি বিশ্বের, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে সম্মান এবং কিছুটা বন্ধুসুলভ। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়, যেমনটি পেয়ে থাকে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্সসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ। এ কারণেই আমাদের স্বল্পোন্নত দেশের দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে এসে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকে কাজে লাগাতে হবে। আগামী নভেম্বরের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার মধ্যেই এই গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরেন্টো, কানাডা।