নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার একমাত্র নায়ক হলো আমাদের সোনার ছেলেরা। অর্থাৎ দেশে জন্মগ্রহণ করে দেশের মায়াসহ সকল আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে সকল ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে নিজের মাতৃভূমিকে ছেড়ে যারা রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবে কাজ করে দেশের আয় উপার্জন করছে। এই সোনার ছেলেরাই হলো আমাদের মূল প্রেরণা ও দেশ উন্নতিকরণের মূল চালিকাশক্তি। আবারও প্রমাণিত হলো- রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই দেশের রিয়েল হিরো। এ দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির প্রধান নায়ক, যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা প্রতিকূল পরিবেশে অমানবিক পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ করছেন। যে রেমিট্যান্সের প্রতিটি স্তরে রয়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ আর দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে দূরে রেখে হাসিমুখে শ্রমে-ঘামে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিনের পর দিন প্রেরণ করে আসছেন, আমাদের অভিবাসী ভাই-বোনরা। অল্পবয়সে বিদেশ গিয়ে, কাছের মানুষ দূরে রেখে, শখণ্ডআহ্লাদ ভুলে গিয়ে, দিন-রাত কাজ করে, সত্য বুকে চাপা দিয়ে হাসিমুখে আপন মানুষকে ভালো থাকতে ও ভালো রাখতে তারা দেশে এ অর্থ প্রেরণ করে থাকেন।
গত কয়েক বছর ধরে বিগত সরকারের আমলে নানা শর্তের বেড়াজালে আইএমএফ আমাদের চার বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত আমরা পেয়েছি ১.৭৫ বিলিয়ন এসডিআর। আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন সরকারি সেবার মূল্যবৃদ্ধি করতে হয়, যার ফলে মূল্যস্ফীতিসহ সমষ্টিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
প্রত্যেক কিস্তিতেই এ ঋণ পাওয়ার আগে আমাদের আইএমএফ কর্তৃক প্রদত্ত শর্তগুলো বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিপালনের প্রমাণাদি প্রদান করতে হয়। অথচ আমাদের প্রবাসীরা কোনো শর্ত ছাড়াই প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছে, যা গত ২০২৪ সালে ছিল ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে চলতি বছরের ১ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২.৯৫ বিলিয়ন ডলার। এ বিবেচনায় মার্চে রেমিট্যান্স ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে; যা স্বাধীনতার পর দেশে একক কোনো মাসে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত রেমিট্যান্স।
২০২৪ সালের ১ থেকে ২৬ মার্চ প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১.৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪-এর তুলনায় ২০২৫ সালের ১ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হার ৮৩.২৩ শতাংশ। মার্চে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে, যার পরিমাণ ৪৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় প্রধান প্রবাসী আয় এসেছে বিশেষায়িত ব্যাংক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে, যার পরিমাণ ২৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকারি ব্যাংকের মধ্যে ২১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স প্রাপ্তির মাধ্যমে শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক।
অভিবাসী ভাই-বোনদের মধ্যে রয়েছে প্রবল দেশপ্রেম। বিগত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিদেশে অবস্থান করে রেমিট্যান্স প্রেরণ বন্ধ করার মাধ্যমে বিগত আওয়ামী সরকারের পতন নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন প্রবাসী ভাই-বোনরা। আওয়ামী সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলসহ জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে হত্যার প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের প্রতি সমর্থন জানিয়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। পতিত আওয়ামী সরকারের মুজিব পরিবারের ঘনিষ্ঠ সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী অভিবাসীদের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেও তারা দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রাখা অব্যাহত রেখেছিলেন।
আওয়ামী সরকারের পতনের পর অভিবাসীরা আবারও রেমিট্যান্স পাঠানো শুরু করলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হতে থাকে। ফলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে আমাদের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। রপ্তানি আয়ের সঙ্গে তুলনা করলে যোগ-বিয়োগের হিসাবে প্রবাসীদের প্রেরিত এ আয়কেই আমরা প্রধান আয় হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। কারণ, রেমিট্যান্স আহরণে সরকারের তেমন কোনো বিনিয়োগ নেই। অথচ আরএমজি খাতে নানা রকম প্রণোদনা প্রদানের পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণ করা বড় এক চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও আরএমজি খাত ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ কলকারখানা স্থাপনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে; যার বড় একটা অংশ ব্যাংকগুলো ফেরত পাচ্ছে না।
বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। কমবেশি সব মিলিয়ে এক কোটির বেশি প্রবাসী বিদেশে অবস্থান করছেন। একজন অভিবাসীর উপার্জনের ওপর পরিবারের চার থেকে পাঁচজন সদস্য নির্ভরশীল। সেই হিসাবে এক কোটি অভিবাসী দেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করছেন। হাজার হাজার অভিবাসী নারী আছেন, যারা সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করে নিজের পরিবারকে দরিদ্র থেকে মুক্ত করে সুন্দর অর্থনৈতিক ভিত তৈরিতে সমর্থ হয়েছেন। নিজের আয়ের টাকা দিয়ে নতুন ঘরবাড়ি তৈরি করেছেন। ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে সঞ্চয় রেখেছেন। ছেলে-মেয়েদের ভালো করে লেখাপড়া শিখিয়ে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। যাদের অবদানের কথা দেশবাসী সবসময় স্মরণ করে।
সরকারের নীতি সহায়তার পাশাপাশি কর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সম্পৃক্ত করে অভিবাসী কর্মীদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা উচিত। শুধু সরকারি কর্মকর্তা ও ভিআইপিদের জন্য নয়, রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য সরকারিভাবে জমি বরাদ্দের সুযোগ রাখা উচিত। মাইগ্রেশন ডিপ্লোমেসি জোরদারের মাধ্যমে কুয়েত, কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়াসহ বন্ধ হওয়া শ্রমবাজারগুলো আবারও চালু করার উদ্যোগ নেওয়া; ইউরোপ-আমেরিকার নতুন টেকসই শ্রমবাজার খুঁজে বের করা; ভারত, শ্রীলংকা, ফিলিপাইনের মতো দক্ষ ও অতিদক্ষ কর্মীসহ প্রফেশনালস প্রেরণে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা; নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সম্পৃক্ত করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিতভাবে কাজ করা; দেশের রিয়েল হিরো রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা এবং সর্বোপরি আমাদের অভিবাসী ভাই-বোনরা বিদেশে অবস্থান করেও দেশপ্রেমের যে উদাহরণ রেখে চলছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে আমাদের প্রবাসী আয় আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। পতিত সরকারের আমলের ভেঙে পড়া অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। দেশের শ্রমবাজারের যেমনটা দুশ্চিন্তা কমবে ঠিক, তেমনি এদেশের অবস্থানের পরিবর্তন হবে খুব সহজে।