নতুন বছর
সমৃদ্ধি অর্জনের অভিপ্রায়
আফতাব চৌধুরী সাংবাদিক ও কলামিস্ট বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দিনবদলের অপরিমেয় প্রত্যাশায় সূচনা হচ্ছে আরও একটি খ্রিষ্টীয় নববর্ষ। উৎসব আর আয়োজনের মধ্য দিয়ে মানুষ অভিবাদন জানাবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের নতুন বছর ২০২১ সালকে। পৃথিবীর বয়স বাড়ল আরও এক বছর। নতুন আশায় বুক বেঁধে আরও একটি নতুন বছরে পা দিল গোটা বিশ্ব। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল আমাদের জীবনের একটি বছর। নতুন স্বপ্ন বুনে অভিলাষী মন উড়ছে, স্বপ্নে ডানা মেলেছে আকাশ ছোঁয়ার দৃপ্ত অঙ্গীকারে। তমসা কেটে পূর্ব দিগন্তে আবহমান সূর্য আবার শুরু করেছে চিরন্তনী নতুন যাত্রা। পৃথিবীর তাবৎ মানুষ নতুন বছরের নতুন সূর্যের জন্যই যেন অসীম প্রতীক্ষায়। সোনালি স্বপ্নের হাতছানি নিয়ে উদিত হলো নতুন বছরের নতুন সূর্য। পৌষের কুয়াশার চাদর ভেদ করে উদ্ভাসিত হলো সোনালি আলোর সকাল। বর্ষপরিক্রমায় নতুন খ্রিষ্টাব্দ আমাদের নতুন ভাবনায়, নতুন সাধনায় অজেয়-অমিত শক্তিতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথের দিকনির্দেশনা দেয়। তাই নববর্ষের সূর্যরাঙা এ দিন একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য দৃপ্তপায়ে এগিয়ে যাওয়ার দিন। অতীতের সব ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে পারি আলোকিত ভবিষ্যতের দিকে। আত্মবিশ্লেষণ, নির্মোহ সমালোচনার মাধ্যমে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও ঐকান্তিকতায় বাস্তবতাকে স্বীকার করে অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলোকে শুধরে ভবিষ্যৎ চলার পথকে প্রশস্ত করার এবং শপথ নেওয়ার দিন। এ দিনে মানুষ নতুন নতুন আশা-আকাক্সক্ষা আর চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে পথচলা শুরু করবে নতুন উদ্যমে। জীবনের খেরোখাতায় সৃষ্টি করবে আনন্দ-বেদনার কাব্যে পাওয়া-না পাওয়ার স্মৃতি-বিস্মৃতির হিসাব-নিকাশের নতুন ধারাপাত। ধূসর ক্যানভাসে আঁকবে জীবনের প্রাপ্তি-প্রত্যাশার চিন্ময় চিত্রপট। নতুন সূর্যের হীরকদ্যুতিতে জেগে উঠবে নব নব প্রাণ।
বিশ্বজুড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে শুরু হয় আতশবাজি, আলোকসজ্জা, নাচ-গান, খাবারের উৎসব আর আনন্দ। বহুমাত্রিক ও বর্ণিল আলোড়ন তোলা নতুনের আবাহনে জেগে ওঠে প্রাণমন। নববর্ষ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী আতশবাজির ঝলমলে রঙে হয়ে ওঠে রাতের আকাশ। কয়েক দশক আগেও নববর্ষকে এমন জাঁকজমকভাবে উদযাপন করা হতো না। উদযাপনের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। খ্রিষ্টীয় নববর্ষকে উৎসব হিসেবে পালন শুরু করার পেছনে রয়েছে এক স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস। বৈশ্বিক পটভূমিতে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অপরসীম।
সর্বপ্রথম নববর্ষ উদযাপন শুরু হয় খ্রিষ্টের জন্মেরও ২ হাজার বছর আগে। সে সময় ২০ মার্চ তারিখের দিকে নববর্ষ উদযাপন করা হতো। পরবর্তী সময়ে কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন দিনপঞ্জিকাকে অনুসরণ করে এসেছে আজকের খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকা। আদি রোমান দিন-পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতি বছর ১ মার্চ নববর্ষ উদযাপন করা হতো। ওই সময় বছর গণনা করা হতো ১০ মাসে। মার্চ মাস থেকে শুরু হতো নতুন বছর। খ্রিস্টের জন্মের ১৫৩ বছর আগে রোমে প্রথমবারের মতো ১ জানুয়ারিতে নববর্ষ উদযাপন শুরু করা হয়। খ্রিষ্টের জন্মের ৪৬ বছর আগে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার প্রাচীন রোমান দিনপঞ্জিকায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে নতুন দিনপঞ্জিকা চালু করেন। এই দিনপঞ্জিকায় ১ জানুয়ারিকে বছরের প্রথম দিন হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে বছরের প্রথম দিন হিসাবে ১ জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। এই দিনপঞ্জিকাকে বলা হতো জুলিয়ান দিনপঞ্জিকা। ৫৬৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এসে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে নববর্ষ হিসেবে ১ জানুয়ারিকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জিকার সূচনা হয়। নতুন এই দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী ১ জানুয়ারিকে আবার নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপন করা হয়। গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জিকার যাত্রা শুরু হলেও প্রথম দিকে উৎসবমুখর নববর্ষ উদযাপন করা হতো না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এসে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালন করা শুরু হয়। এরপর ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসেবে আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হতে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ১৭৫২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালন করা শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে ১ জানুয়ারি ঘটা করে উৎসবমুখরভাবে বিশ্বের সব দেশে নববর্ষ পালন শুরু করা হয়। ইউরোপের অনেক দেশে এ দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্বের সব দেশে গ্রেগরিয়ান নববর্ষ উদযাপিত হলেও সব দেশে এটি প্রধান নববর্ষ উৎসব নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আরবি নববর্ষ বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ এবং চীনে চীনা নববর্ষের পঞ্জিকা অনুসারে নববর্ষ পালন করা হয়।
খ্রিষ্টীয় নববর্ষের আলো ঝলমল সূচনা মুহূর্ত নিয়ে উচ্ছ্বাস-উল্লাস বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও পাশ্চাত্য প্রভাব শহরাঞ্চলে এর ব্যাপ্তি ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ নববর্ষ উদযাপনে উদ্দীপিত। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর যারা জীবিকার কঠোর সংগ্রামে, সমস্যার ভারে বিধ্বস্ত, এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামানোর কোনো অবকাশ নেই তাদের জীবনে। তবুও জীবন চলে জীবনের টানে, কখনও একফালি জ্যোৎস্নার চাঁদ, আবার আলো ফেলে না বর্ণিল স্বপ্ন বিভায়।
বাঙালি সংস্কৃতির বলয়ের বাইরে হলেও অনেক স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রতি বছর পহেলা জানুয়ারি আমাদের মধ্যে আসে স্বপ্ন-সাহসে উল্লাসে। আমরা দিনটিকে বরণ করে নিই বিশ্বায়নের গতিময় ও ছন্দময় জীবন সাজানোর তাগিদে। তার পরও আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ধারণ করে বাঙালি হৃদয়ে আবর্তিত হয় বাঙালির পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ। রাঙায় জীবন এবং অঙ্গীকার করি নতুন বছরে নতুনভাবে জীবনের স্বপ্নগুলোকে শানিত চেতনায় বাস্তবে রূপ দিতে।
সময়ের স্রোতে একেকটি বছর গত হলেও ২০২০ ছিল অনন্য। মুক্তিযুদ্ধের চেনার সঠিক ধারার প্রতিফলন এবং পুনর্জাগরণের নতুন সম্ভাবনা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। অপশক্তির বিরুদ্ধে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইতিহাসের এক মহাসড়কে। সূচিত হয়েছে নবযাত্রা বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে। পর্বত সমান প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এবং সহিংসতা মোকাবিলা করে দেশের মানুষ সাহসিক অভিযানে দেশের অগ্রযাত্রার মিছিলে শামিল হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের কলঙ্ক মুছে বাংলাদেশ আজ পরিচিত পাচ্ছে অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী দেশের তালিকা থেকে নাম মুছে ফেলা হিসেবে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ শক্ত হাতে দমনে দৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখেছেন।
একাত্তরের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ শূন্য থেকে মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, সংগ্রাম আর নিষ্ঠার মাধ্যমে আজ মহিরুহে পরিণত হয়েছে। স্বনির্ভর অর্থনীতির মানদ-ে বাংলাদেশ এখন নিজস্ব শক্তি ও প্রেরণায় দেশে বিরাজমান সমস্যাগুলো দূর করে ভিশন ২০২১-এর সফল বাস্তবায়ন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের অর্জিত ও দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে এবং ক্রমান্বয়ে উন্নত দেশে পরিণত করার সংকল্পে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে ঐক্যের পতাকাতলে দাঁড় করিয়েছেন।
নতুন বছরের সূচনায় আমরা প্রত্যাশা করছি উন্নয়নের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ভিন্নমতের ব্যবধান কমিয়ে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রবাহকে বেগবান করবেন। কেননা স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মপরিবেশ এবং চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারলেই দেশ এগিয়ে যাবে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশগ্রহণ জরুরি। উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে হবে উন্নত দেশের কাতারে। বিজয়ের সাড়ে চার দশকে ঐকান্তিক চেষ্টায় সহাস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনসহ অনেক চ্যালেঞ্জ জয় করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে। বিশ্বমন্দার দুর্যোগের বিরূপ প্রভাব ছুঁতে পারেনি দেশের অর্থনীনিকে। অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক বেশিরভাগ সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়াকে এবং বিশ্বের তাবৎ দেশকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। অবকাঠামো, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ও বন্দরের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য বিপুল অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। সমৃদ্ধি অর্জনের অভিযাত্রায় আমাদের যেতে হবে আরও অনেক দূর।
দারিদ্র্যকে নির্মূল করে মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে সমাজের সব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমৃদ্ধশালী বিশ্বব্যবস্থার জন্য জনগণের জীবনকে রূপান্তর করতে হবে। সমৃদ্ধিশালী বিশ্বব্যবস্থার জন্য জনগণের জীবনকে রূপান্তর করতে উন্নয়নকে ধ্রুব নক্ষত্র করে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যেতে হবে। হিসাবের খাতায় ব্যর্থতার গ্লানি মুছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে নতুন বছরে নতুন শপথে বলীয়ান হবে দেশের মানুষ। শান্তিকামী মানুষ সহিংসতা, হত্যা-খুন কিংবা হানাহানির রাজনীতি পরিহার করে ২০২১ সালকে সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। নবচেনার নববর্ষে নতুন দিনের নতুন সূর্যালোকে অগ্নিশপথে উদ্দীপিত হবে জাতি। বিগত বছরের সব কালিমা ধুয়ে-মুছে এগিয়ে যাবে সময়, সভ্যতা, হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানিমুক্ত রাজনীতি, অর্থনীতি আর সংস্কৃতির পথ ধরে অনাবিল স্বপ্ন আর অফুরন্ত প্রাণোন্মদনায়।
আমাদের প্রত্যাশা, একটি স্থিতিশীল ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন। আর তা নতুন বছরের সামগ্রিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আরও কয়েকধাপ এগিয়ে যাবে এবং নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে আমাদের জীবনে সর্বোপরি জাতির জীবনে। আগামীর একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে যাত্রা শুরু হোক সবার। আগামী পৃথিবী হোক অহিংসার বাতাবরণে যুদ্ধ-সংঘর্ষহীন এবং সবার জীবন হোক নবতর চেতনায় ঋদ্ধ।