যে নদীর অপরূপ দৃশ্য দেখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়ে উঠেছিলেনÑ ও নদীরে, একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে/বল কোথায় তোমার দেশ/তোমার নেই কি চলার শেষ। দেশের সেই নদীগুলোর ওপর অন্যায়-অবিচারের দূষণ চিত্র দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে গঙ্গার কাছে জানতে চান, তবুও তুমি বইছ কেন? (ভূপেন হাজারিকা)।
বর্তমান সরকার দেশের নদনদীগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় ১৭৮টি নদী খনন ও পুনরুদ্ধার করে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চলাচলের উপযোগী করার কাজ শুরু করেছে। এ প্রকল্প ২০২০-২০২১ সালে শুরু হয়ে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
প্রথম অবস্থায় ঢাকার চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদী খনন ও দূষণমুক্ত করা হবে। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় চট্টগ্রাম থেকে আশুগঞ্জ হয়ে বরিশাল পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার খনন কাজ আগামী বছরে শুরু হবে। এর সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ঝিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদী খনন ও বন্যা ব্যবস্থাপনায় ৪ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া ভারত-বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে দুই দেশের নৌ প্রটোকলভুক্ত ৪৭০ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়েছে। এর আওতায় কালনি ও কুশিয়ারা নদীর আশুগঞ্জ, জকিগঞ্জ নৌপথের ২৮৫ কিলোমিটার এবং যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ-দৈখাওয়ার ১৮৫ কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হয়েছে।
বরিশাল বিভাগে ৩১টি নদী খনন, রক্ষণাবেক্ষণে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। খুলনা বিভাগে ১২টি নদী ৬৫০ কিলোমিটার খনন ও বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে ৭ হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে। নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা নদী খননের পাশাপাশি নদীখেকো ও দখলদাররা যাতে আবার নতুন করে দখল করতে না পারে, সে লক্ষ্যে তদারকি ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেও সারা দেশে নদী দূষণমুক্ত রাখার জন্য অদ্যাবধি তেমন কোনো ভূমিকা নেওয়া হয়নি। নদী দূষণমুক্ত রাখা না গেলে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নদী সচল রাখার সব উদ্যোগ ব্যাহত হতে পারে।
দেশে নদনদী দখল ও দূষণের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দীর্ঘদিন ধরে এদিকে খেয়াল না দেওয়ায় দেশের ২৩০টি নদনদী আজ মৃতপ্রায়। এ সব নদনদী প্রায় ১০ হাজার প্রভাবশালী ভূমিদস্যু দখলবাজ দীর্ঘদিন ধরে দখল করে আসছে। তাছাড়া নদীগুলো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মিল-কলকারখানার বর্জ্য, নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা শহর, নগরের মানুষের ব্যবহারের দূষিত নোংরা পানি, শহর বাজারের (মাছ, মাংস বাজারের নোংরা বর্জ্য) ড্রেনে দীর্ঘদিন জমে থাকা দূষিত বর্জ্য সরাসরি ড্রেনের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযোগ রাখার কারণে সাংঘাতিকভাবে নদীদূষণ হচ্ছে। মৃতপ্রায় এসব নদনদী দেখলে মনে হয় এ যেন বর্জ্য রাখার ভাগাড়। এসব নদনদী ধ্বংস করার পেছনে কাজ করছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সম্প্রতি সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ৪ ক্যাটাগরিতে ১ হাজার ৮৯ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গিয়েছে (সূত্র : সংবাদ ১৩-০৩-২০২০)। এতে বলা হয়েছে, নদনদী দখলবাজদের সঙ্গে অধিকাংশ স্থানীয় ভূমি অফিস ও বিআইডব্লিউটিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় ক্ষমতাধর প্রভাবশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। সারা দেশে নদী দখল ও দূষণের চিত্রটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
নদীদূষণ ও দখল এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রায় প্রতিদিনই নদীদূষণের ও দখলের খবর মিডিয়ার মাধ্যমে চোখে পড়ে। বিআইডব্লিউটিএ সব বিষয়ে দেখভাল করার কথা থাকলেও তারা সেটা না করে অনেক ক্ষেত্রে দখলদারদের সহযোগিতা করে আসছে। সারা দেশে নদীনালা, খালবিল অবৈধভাবে দখল হওয়ার কারণে পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশের অধিকাংশ মিল-কলকারখানার বর্জ্য ও বসতবাড়ি, হাটবাজারের নোংরা দূষিত পানি, মৃত প্রাণী, প্রাণীর পচা উচ্ছিষ্ট অংশ অহরহ নদনদীতে ফেলা হচ্ছে। শহর এলাকায় বস্তিবাসীর অপরিকল্পিত অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবস্থা ও বিভিন্ন ভবনের টয়লেট ড্রেনের সঙ্গে সংযোগ করে নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদনদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী ও জলজপ্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। নদীদূষণ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বড় বড় শহরের পাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে খাল নদীর সঙ্গে সংযোগ রাখায়। ঢাকা শহরের পরিবেশ দূষণ অস্বাস্থ্যকর বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধযুক্ত পানি ও বিভিন্ন খাল-ডোবার দিকে তাকালেই এ দৃশ্য চোখে পড়ে। এভাবে নদীদূষণ ও দখলের কারণে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। তাছাড়া নদীর প্রবাহ না থাকায় প্রতি বছরই বর্ষাকালে মারাত্মক বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। নদীদূষণকারী শুধু প্রভাবশালী কলকারখানার মালিকরাই নয়, সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্নভাবে নদনদী দূষণ করছে। দেশের নদীগুলোর পাড়ে গড়ে ওঠা সিটি শহর ও শত শত পৌর এলাকায় বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া দেশে সুগার মিলগুলো অস্বাস্থ্যকর বর্জ্য, রোগজীবাণু বহনকারী মশা-মাছির উপদ্রব ও বংশ বিস্তারের সাহায্য করে। এ বর্জ্যগুলো ড্রেনগুলোর মাধ্যমে সরাসরি নদীতে সংযোগ করা হয়, যা নদীদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ।
দেশের বেশিরভাগ মিল-কলকারখানার বর্জ্য, নিজস্ব শোধনাগার না থাকায় দূষণকারীরা নদীগুলোকে তাদের নিজস্ব সম্পদ মনে করে নদী দূষণ করে পরিবেশ নষ্ট করছে। নদী দখল ও দূষণকারীরা এতই শক্তিশালী যে, রাষ্ট্রীয় সব উদ্যোগ তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। তাছাড়া নদী দখল এবং দূষণ ঠেকানোর জন্য সরকারি যেসব সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া আছে, দৃশ্যমান এসব অনিয়ম দেখেও তাদের চুপ থাকার রহস্য উন্মেচিত হওয়া দরকার। অনেক সময় আমরা দেখেছি, সরকারের পক্ষ থেকে নদনদীমুক্ত করতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে প্রভাবশালীদের বাধার সম্মুখীন হয়ে আর বেশিদূর এগোতে পারে না, থেমে যায়। ক্ষমতাশীল, প্রভাবশালীদের স্বার্থের কাছে নদী উদ্ধারের উন্নয়নকাজ ব্যাহত হোক, দেশের ১৭ কোটি মানুষ তা আশা করে না।
নদী রক্ষায় শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, বাস্তবায়নও করতে হবে। নদীর তীরে মিল-কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। এর আগে যেসব মিল-কলকারখানার বর্জ্য শোধনাগার নেই, সেগুলোর শোধনাগার তৈরি বাধ্যতামূলক করতে হবে। দেশের বড় বড় শহর, সিটি শহর, জেলা শহর, পৌর এলাকা দূষিত বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত না করে শোধনাগারের মাধ্যমে শোধন করতে হবে। সমুদ্রের পাড়ে জাহাজভাঙা শিল্প নদীদূষণ ও পরিবেশ দূষণের কারণে বন্ধ করতে হবে অথবা নদীদূষণ ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। লঞ্চ-স্টিমার নির্মাণ ও মেরামতকালে নদী ও সমুদ্রের পাড়ে তৈলাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ বন্ধ করতে হবে।
পানিই জীবন, কথাটি মনে রেখে সর্বদা পানির প্রবাহ সচল রাখতে নদী খননের সঙ্গে সঙ্গে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নদীদূষণও ঠেকাতে হবে। যেহেতু ক্ষমতাবান প্রভাবশালীরা নদীকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, নদীগুলো উদ্ধারের কাজে সরকারের সঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে কাজকে বেগবান করতে পারলে, খননের সঙ্গে সঙ্গে নদীদূষণমুক্ত হলে দেশের ২৩০টি নদী বাঁচবে, জলজপ্রাণী বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে, দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচবে।