ঢাকা ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ মাঘ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বজ্রপাত দুর্যোগ থেকে আমাদের সতর্কতা প্রয়োজন

বজ্রপাত দুর্যোগ থেকে আমাদের সতর্কতা প্রয়োজন

সম্প্রতি সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত লোকের প্রণহানি হয়েছে এবং প্রায় শতাধিক লোক আহত হয়েছে। প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে বজ্রপাত ইদানীং বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি করছে এবং প্রতিনিয়ত অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটছে। ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির দিক থেকে বিবেচনা করে বজ্রপাতকে নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করছেন গবেষকরা। বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বজ্রপাত মানুষের পরিচিত সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। প্রতি বছর এপ্রিল থেকে প্রায় প্রতিদিনই বজ্র দুর্যোগে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। বজ্রপাতে আহতরা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। হাওর-বাঁওড় ও বিল এলাকার জেলাগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যু বেশি। ঝড়-বৃষ্টির সময় খোলা মাঠ, নৌকা ও পথঘাটে যারা চলাচল করে তারাই এর শিকার। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বজ্রপাতের ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে, বজ্রপাতে একটি মৃত্যু হলে আরও ১০ থেকে ১৫ জন আহত হন। অন্য দুর্ঘটনায় আহত আর বজ্রাঘাতে আহতের মধ্যে পার্থক্য আছে। এই দুর্ঘটনায় আহতরা স্থায়ীভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। সাধারণত এ দুর্যোগের শিকাররা সংশ্লিষ্ট পরিবারের সবচেয়ে কর্মক্ষম ব্যক্তি। সম্প্রতি বাংলাদেশসহ পৃথিবীজুড়ে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০টি বজ্রপাত হয় বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। পৃথিবীর বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলের একটি বাংলাদেশ।

এ অস্বাভাবিকতার কারণ হচ্ছেÑ বায়ুম-লে কালো মেঘ বেড়ে যাওয়া। কালো মেঘ সৃষ্টির পেছনে বাতাসে নাইট্রোজেন ও সালফারের পরিমাণ বাড়াকেই দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ৮০ লাখ বজ্রপাত সৃষ্টি হয়। উন্নত দেশগুলোতেও একসময় বজ্রপাতে বহু মানুষের মৃত্যু হতো। কিন্তু তারা বজ্রনিরোধক খুঁটি বা পোল স্থাপন করা, মানুষকে সচেতন করার মধ্য দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে এনেছে। তবে তার আগে বৈজ্ঞানিক তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাভিত্তিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছে উন্নত দেশগুলো। এতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলোসহ পূর্ব-এশিয়ায় বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা বহুলাংশে কমেছে। যদিও বজ্রপাত সম্পর্কে অনেক কল্পকাহিনি প্রচলিত, বিজ্ঞানের কল্যাণে বজ্রপাতের কারণ পরিষ্কার হয়েছে। সহজ ভাষায় বায়ুম-লে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জের গঠন ও পৃথকীকরণে বজ্রপাত সংঘটিত হয়।

সারা বছরের হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত সংঘটিত হয় ভেনেজুয়েলার মারাকাইবো হ্রদে। অন্যদিকে আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকার অবস্থান দ্বিতীয়।

বজ্রপাত বলতে আকাশের আলোর ঝলকানিকে বোঝায়। এই সময় ওই এলাকার বাতাসের প্রসারণ এবং সংকোচনের ফলে আমরা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এ ধরনের বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন দুটি মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ এবং ভূমির মধ্যেও হতে পারে। বাযুম-লের ওপরের অংশে নিচের তুলনায় তাপমাত্রা কম থাকে। এ কারণে অনেক সময় দেখা যায় যে, নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে মেঘের প্রবাহ হয়। এ ধরনের মেঘকে থান্ডার ক্লাউড বলে। অন্যান্য মেঘের মতো এ মেঘেও ছোট ছোট পানির কণা থাকে। আর ওপরে উঠতে উঠতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে পানির পরিমাণ যখন ৫ মি.মি’র বেশি হয, তখন পানির অণুগুলো আর পারস্পারিক বন্ধন ধরে রাখতে পারে না। তখন এরা আলাদা হয়ে যায়। ফলে সেখানে বৈদ্যুতিক আধানের এর সৃষ্টি হয়। আর এ আধানের মান নিচের অংশের চেয়ে বেশি হয়। এরকম বিভব পার্থক্যের কারণেই ওপর হতে নিচের দিকে বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমন হয়। এ সময় আমরা আলোর ঝলকানি বা ব্রজপাত দেখতে পাই। ২০১৩-২০২০ (জুন পর্যন্ত) দেশে মোট ১ হাজার ৮৭৮ জন লোক বজ্রপাতে মারা গেছে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭২ শতাংশ কৃষক। চলতি মে মাস দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সারা বছরের হিসাবে বজ্রপাতকে অন্য কোনো দুর্যোগ টপকে যেতে পারবে না। কারণ, ২০১৯-২০ সালের মধ্যে দেশে এক বজ্রপাতই হয়েছে ৩১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি। এর ২৬ শতাংশের বেশি তৈরি হয় মে মাসে। বাংলাদেশে বছরে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাত হয়। তবে বাংলাদেশের মানুষের সৌভাগ্য যে, এ বজ্রপাতের সব ক’টি শরীরে এসে আঘাত করে না। তাই যদি হতো, তাহলে কী হতো, তা কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংবাদ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামান্য বৃষ্টিপাত বা ঝড়ো বাতাসেও ঘটছে বজ্রপাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে, যার পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। বনের পরিমাণ এবং উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়াকেও বজ্রপাতে মৃত্যুর কারণ মনে করছেন। বড় গাছগুলো আগে বিজলীর বিরুদ্ধে কাজ করত, ফলে প্রাণহানি কম হতো। এক সময় দেশের বেশিরভাগ গ্রামে বড় গাছ থাকত। তাল, নারিকেল, বটসহ নানা ধরনের গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নিত। বিভিন্ন কারণে বড় গাছগুলো উজাড় হওয়ায় বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এর জন্য জরুরি প্রয়োজন বনায়ন। বজ্রপাত থেকে বাঁচতে কতগুলো জরুরি নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। এর ফলে জীবন রক্ষা পাওয়ার সম্বাবনা বেশি থাকবে। কিছু কিছু নিয়ম মেনে নিজেকে এবং পরিবারের সদস্যদের বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। বজ্রপাতের সময় এই সব সচেতনতামূলক বিষয়গুলো খেয়াল করে চললে প্রাণহানিসহ অন্যান্য ক্ষতি থেকে নিজেকে এবং পরিবারের সদস্যসহ অন্যান্যদের রক্ষা করা সম্ভব। যেমনÑ বজ্রপাতের ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ না করা। প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ্র নিরোধক স্থাপন নিশ্চিত করা। খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যাওয়া। কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে অবস্থান করা। খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। গাছ থেকে চার মিটার দূরে থাকতে হবে। কারণ বড় গাছের মধ্যে বজ্রপাত হলে সেই গাছের ডালপালা ভেঙে মাথায় পড়তে পারে। ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক তারের নিচ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য বৈদ্যুতিক লাইন বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। যদি কেউ বজ্রপাতে আহত হয়, তাহলে বজ্রপাতে আহতদের বৈদ্যুতিক শকের মতো করেই চিকিৎসা দিতে হবে। এসময় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে অকারণে ঘোরাফেরা করা থেকে বিরত থাকাই উত্তম।

বজ্রপাতের সময় যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া। বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় না থাকা এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকা। ঘনকালো মেঘ দেখা গেলে, অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হওয়া উত্তম। বজ্রপাত শুরু হলে উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, তার, ধাতব খুঁটি ও মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা। বজ্রপাতের সময় জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা। বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, মাঠ বা উঁচু স্থানে না থাকা। গ্রামগঞ্জে বিশেষ করে কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা, জলাশয় থেকে দূরে থাকা। বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখা এবং নিজেরাও এসব থেকে বিরত থাকা। বজ্রপাতের সময় খোলামাঠে থাকলে, পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়া। বজ্রপাতের সময় গাড়ির মধ্যে অবস্থান করলে, গাড়ির থাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ যেন না ঘটে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা। সম্ভব হলে গাড়িটিকে নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া। ফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকা। বিশেষ করে জেলেদের ক্ষেত্রে বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করা উচিত।

দেশি-বিদেশি গবেষণা বলছে, দেশে গত কয়েক বছরে কালবৈশাখীর পাশাপাশি বজ্রপাত বেড়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ে একক কোনো কারণ চিহ্নিত করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। অনেকটাই ধারণানির্ভর তথ্য তারা মনে করছেন, তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহারের আধিক্য, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আর এই সব কটির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে। বিশ্বখ্যাত সায়েন্স পত্রিকার নিবন্ধে ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বজ্রপাত। প্রযুক্তির ব্যবহার করে বজ্রপাতে মৃত্যু কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে, তবে সচেতনতা এবং সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। এখনই এই দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে করোনার ন্যায় এটি স্থায়ী রূপ ধারণ করতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত