দেখতে দেখতে চলে গেল আরও একটি বছর। ২০২১ পেরিয়ে চলে এলো ২০২২ সাল। অনেক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, হাসি-কান্নার মাধ্যমে বছরটির সমাপ্ত হলো। নানা আলোচনা-সমালোচনার বছরটি বিদায় দিয়ে ২০২২ সালে পদার্পণ করেছে বিশ্বের সব দেশ। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এদেশেও নতুনের কদর রয়েছে। রয়েছে নতুন বছরে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।
এ প্রজন্মের কাছে নতুন বছর মানেই নতুন কিছু। তাই তারুণ্যের প্রত্যাশার পাল্লাটাও একটু ভারী। আমরা যখন নতুন কিছু নিতে যাই, তখন সবসময় ভালোটাই চাই। ২০২১ সালের সব ভুল-ভ্রান্তি ভুলে গিয়ে আমরা পেতে চাই আরও সুন্দর এবং সাজানো গোছানো একটি বছর। বছরটির শুরুতেই প্রয়োজন পরিকল্পনা। আমরা জানি, পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কিছুই সঠিকভাবে সফল করা যায় না। তাই নতুন বছরটা শুরু করতে হবে সুন্দর পরিকল্পনা দিয়ে। আর এই পরিকল্পনায় রাখতে হবে সবাইকে। একপেশে পরিকল্পনা করা আর না করা একই। দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, ধনী সবার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে সমানভাবে। তবে মনে রাখতে হবে, চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে যদি বিস্তর ব্যবধান থেকে যায়, সেই চাওয়ার আর মূল্য থাকে না। তাই নতুন বছরে সবার প্রত্যাশাগুলো যেন প্রাপ্তিতে সমাপ্ত হয় সেটা মাথায় রেখে কাজ শুরু করতে হবে।
সেই সঙ্গে বর্তমান সরকারের ভাবনায় রাখতে হবে, এ প্রজন্মের চাওয়াগুলো। তরুণদের প্রত্যাশা যদি প্রাপ্তিতে পরিণত হয় তবে দেশটা হবে অনেক সুন্দর এবং গোছানো। তরুণদের নিয়ে সোনার বাংলা সাজাতে হবে সরকারকে। দেশের উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই তরুণদের সঙ্গে নিয়ে এগুতে হবে। সেইসঙ্গে বেকার তরুণ-যুবকদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে নতুন বছর দিয়ে। এবারের নতুন বছরটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে নতুন স্বপ্নের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে এগুতে হবে সবার।
শুধু তা-ই নয়, আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, একটা দেশের মূল চালিকাশক্তি এবং ভবিষ্যৎ হচ্ছে তরুণরাই। সোনার বাংলা গড়ার কারিগর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই তার তরুণ বয়সে দেখিয়েছেন তরুণরা কতটা করতে পারে দেশের জন্য। আমরা বঙ্গবন্ধুর তারুণ্যের সময়কাল দেখলেই জানতে পারব তরুণ বঙ্গবন্ধু কতটা সফল ছিলেন। সেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বর্তমান তরুণ প্রজন্মও সফল হতে চায়। এজন্য তারুণ্যের চাওয়াগুলো প্রাধান্য দিতে হবে সবার।
তারুণ্যের চাওয়াগুলো নিয়ে যদি কথা বলতে হয়, তবে প্রথমেই উঠে আসবে বেকারত্ব। এ প্রজন্মের সবচেয়ে বড় হতাশা আর দুঃখের কারণ হচ্ছে বেকরত্ব। বাংলাদেশে যতগুলো সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে বেকারত্ব। বেশি অবাক হতে হয় তখন, যখন আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকার অধিক। বেকারত্ব দূর করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ থাকলেও বাস্তবে এ সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে যে পরিমাণ বেকার ছেলেমেয়ে রয়েছে সে পরিমাণ এখনও কর্মসংস্থান নেই। এটি আমাদের জন্য বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্ব দূর করতে হলে সর্বপ্রথমে পর্যাপ্ত পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এটাই এ প্রজন্মের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের দেশের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে তারা চলে যাচ্ছে ধ্বংসের পথে। তাদের এই ধ্বংসের পথ থেকে সরিয়ে আনার জন্য অবশ্যই বেকারত্ব দূর করতে হবে। অনেকে পেটের জন্য অবৈধ পথ বেছে নিতে কোনো প্রকার চিন্তা করছে না। কেউ মাদক, কেউ ইয়াবাসহ নানা রকমের নেশাজাতীয় দ্রব্য নিয়ে ধ্বংস করছে নিজেদের জীবন। আর তাদের এ ধ্বংসের কারণ হচ্ছে বেকার জীবন। বেকারত্বই সব ধ্বংসের মূল। বেকারদের চাকরি না পাওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে ঘুষ। স্বজনপ্রীতি আর টাকায় এখন চাকরি পাওয়া যায়। বাবা, চাচা, মামা, খালু না থাকলে আজকাল চাকরি তো দূরের কথা চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো ক্ষমতা আমাদের নেই।
পড়ালেখা শেষ করে যদি একজন শিক্ষিত ছেলে তার যোগ্যতা অনুসারে একটি চাকরি না পায়, তবে সে ছেলেটি দেশের জন্য বোঝা হবে তো বটেই অনেক সময় দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়েও দাঁড়াবে। এই যুব সমাজকে বাঁচতে এগিয়ে আসতে হবে সবার। দেশের প্রতিটি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে বেকার যুবকদের। বেকারত্ব দূর করার জন্য আমাদের সবার এক হতে হবে। সরকার এবং দেশের বিত্তবানদের এ বিষয়ে সুদৃষ্টি দিতে হবে। বেকার যুবসমাজ পচ্ছে না কোনো চাকরি, মেটাতে পারছে না পরিবারের চাহিদা। বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে অবৈধ পথে। চলে যাচ্ছে ধ্বংসের পথে। যে পথে থাকে না কোনো সুখ; কিন্তু থাকে কালো টাকা। কেউ জঙ্গি, কেউ সন্ত্রাসী এভাবেই চলে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে। আসলে এর জন্য দায়ী এই সমাজ। কোনো এক গবেষকের কথা, একজন ব্যক্তি যখন কোনো কর্মহীনভাবে থাকে তখন নাকি তার মাথায় খারাপ চিন্তা আসে। আসলেই কথাটি সত্য। আর এই কর্মহীন ব্যক্তিরাই সমাজের ক্ষতি করছে। এখন কর্মসংস্থানে দুর্নীতির মাত্রা অতিরিক্ত ভাবে বেড়েছে। তাই সরকার এবং প্রশাসনের প্রয়োজন এই বিষয়টিও তাদের নজরে রাখবেন। ঘুষ ছাড়া যেন চাকরি নেই! এটা এখন সহজ একটি কথা। বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে এটি বেশি প্রযোজ্য। এ প্রজন্মের কাছে বেকরত্বের সমাধান পাওয়াটা খুবই জরুরি।
এছাড়া আমাদের দেশে আজ খেলার মাঠের বড় সংকট। একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি তা হচ্ছে খেলাধুলা। এছাড়া খেলাধুলা তরুণ এবং যুবসমাজকে মাদক থেকে দূরে রাখে। কিন্তু সারাদেশে খেলার মাঠ যেন দিন দিন কমে যাচ্ছে। বলা যায় এখন খেলার মাঠ খুব বেশি নেই। প্রতিটি খালি জায়গা এখন দালানকোঠায় রূপান্তরিত হচ্ছে। খালি কোনো জায়গা নেই, যেখানে বাচ্চারা একটু খেলবে এবং দৌড়াবে। পক্ষান্তরে কিন্তু লোকসংখ্যা বাড়ছে। এতে করে শিশুর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। ভবিষ্যতে এই শিশুরা মাঠ কোথায় পাবে সেটাও বড় চিন্তার বিষয়। এখন তরুণ ছেলেরাও খেলার জন্য মাঠ খুঁজে পায় না। মাঠ আছে শুধু জাতীয় পর্যায়ে খেলার জন্য। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে খেলার জন্য তৈরি হতে যে আগে খেলতে হয়, সেটা আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। নতুন নতুন স্টেডিয়াম হচ্ছে। কিন্তু এদিকে শিশু, তরুণ, যুবকরা খেলার জন্য মাঠ খুঁজে পায় না। ছোট ছোট খালি জায়গায়ও অনেক সময় ছেলে মেয়রা ক্রিকেট, ফুটবল খেলে। কারণ তাদের ভেতর খেলাধুলার ইচ্ছা এবং আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু সেই ইচ্ছা এবং আগ্রহ একদিন মাঠের অভাবে হারিয়ে যাবে এসব শিশুদের। আর তরুণ এবং যুব সমাজরা হয়ে উঠবে ফেইসবুক এবং মাদকনির্ভর। কারণ খেলাধুলা খেলতে না পারলে বিকেলের অবসর সময় তারা নানাভাবে নিজেদের জড়িয়ে ফেলতে পারে।
এর মধ্যে মাদকাসক্ত অন্যতম। মাদক থেকে তাদের বাঁচাতে স্থানীয় প্রশাসনকে এই বিষয়ে নজর দিত হবে। আমরা মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য কতই সেøাগান এবং আন্দোলন করি; কিন্তু বাস্তবে মনে হয় আমরা যেন মাদকের পক্ষ নিয়ে কাজ করি। আমরা বলি, ‘খেলাধুলায় বাড়ে বল, মাদক ছেড়ে খেলতে চল’Ñ কিন্তু খেলতে কোথায় যাবে সেটা কেউ আর ঠিক করে দেয় না। তরুণদের জন্য প্রতিটি এলাকায় একটি করে উন্মুক্ত খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, তরুণ প্রজন্মকে মাদকের আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে চাইলে খেলাধুলায় উৎসাহী করে তুলতে হবে। আর এই খেলাধুলার জন্য মাঠের বিকল্প নেই। আমরা যদি আশপাশে লক্ষ করি, তাহলে দেখতে পাব তারাই ভালো আছে যারা খেলাধুলা করে।
কিন্তু এই খেলাধুলার মাঠ না থাকলে শিশু এবং তরুণ সমাজ একদিন হুমকি হয়ে দাঁড়াবে দেশের জন্য। আগামী দিনের ভালো মানের খেলোয়াড় খুঁজে পাবে না বাংলাদেশ। মাদক এবং নেশায় আসক্ত হতে সময় লাগবে না তরুণ সমাজের। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে মাঠ তাতে মনে হয় অতি সন্নিকটে আমাদের দেশে ভয়ংকর এক সময় আসবে। তাই আসুন আমরা সবাই এই বিষয়টিকেও গুরুত্ব সহকারে দেখি এবং খেলার মাঠ তৈরি করে দিই শিশু ও তরুণদের। নতুন বছরে এটাও একটা তারুণ্যের প্রত্যাশা।
তাছাড়া আমাদের দেশে বর্তমানে মাদকের ছড়াছড়ি। আমাদের যদি সমাজকে মাদকাসক্তির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে বন্ধ করতে হবে মাদক ব্যবসা। তা নাহলে মাদকের রাজত্ব আজীবন থেকে যাবে। আর সমাজে অনৈতিকতার প্রসার বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশে আনুমানিক মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখের ওপরে। প্রতি বছর কয়েক লাখ তরুণ তরুণী মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকাসক্তির ৫৫ ভাগই বেকার এবং শিক্ষার্থী। যারা মাদকের অর্থ জোগাতে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল। আর এর কারণে পরিবারে নেমে আসে চরম অশান্তি। এরাই করে সমাজে নানা কুকর্ম। ছিনতাই সহ চুরি-ডাকাতির কাজও করে এসব মাদকসেবীরা। সিমান্ত এলাকায় মাদক প্রতিরোধের নামে যেসব কমিটি গড়ে উঠেছে, সেগুলোর ৮০ ভাগ সদস্য নিজেরাই মাদক ব্যবসায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। মাদকের বড় একটা অংশ আসে মিয়ানমার সিমান্তবর্তী নাফ নদে মাছ ধরা জেলেদের মাধ্যমে। মিয়নমার থেকে এভাবে চোরা পথে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক এসে নষ্ট করে দেয় যুবসমাজের জীবন। আর এই ব্যবসায় জেলেরাও অতিরিক্ত আগ্রহ দেখায়, কারণ নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পরে মাদকই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। অনেকের মতে মাদক থেকে মাফিয়াদের আয়ের একটি অংশ বিভিন্ন দেশের কর্ণাধারদের পকেটে যায় সরাসরি অথবা নানা ছদ্মাবরণে। এ কারণে বিশ্বব্যাপী মাদকের বিরুদ্ধে কেবল ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলে।
আমাদের দেশের প্রতিটি স্থানেই এখন মাদক পাওয়া যায়। চাইলেই এখন মাদক সংগ্রহ করা যায়। ইয়াবা থেকে শুরু করে গাঁজা, মদসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য এখন হাতের নাগালে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকের এই ভয়ংকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সমাজে ভালো মানুষের মুখোশ পরে আড়ালে মাদকের ব্যবসা করাটাই এখন অনেকের আদর্শ, যা আমরা খালি চোখে দেখি না। তবে যারা দেখি তারাও বলতে পারি না ভয়ে। তবে এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও দক্ষ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তা না হলে মাদকবিরোধী অভিযান চললেও মাদকের আগ্রাসন কখনও থামবে না। তাই তরুণসমাজকে রক্ষা করতে হলে মাদকের ছড়াছড়িও বন্ধ করতে হবে। এছাড়া আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার যে মহামারি লেগে আছে তা রুখতে হবে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। তাই নতুন বছরে সরকারের কাছে অন্যতম প্রত্যাশা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার। আরও একবার এই সড়ক নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, তারুণ্যের চাওয়া এবং প্রত্যাশাগুলো যেন প্রাপ্তি দিয়ে পূরণ হয়। তবেই দেশ এবং দেশের মানুষ উপকৃত হবে। মনে রাখতে হবে, একটি দেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছতে চাইলে সেদেশের তরুণ সমাজকে গুরুত্ব দিতে হবে। দিতে হবে তারুণ্যের মতামতকে প্রাধান্য। তবেই সোনার বাংলা গড়তে পারব আমরা।