আহমেদ রুবেল। জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন তার শিল্পী জীবনের সহকর্মীদের সঙ্গে। শিল্পকলা একাডেমিতে অসংখ্যবার তিনি গিয়েছেন। কিন্তু গতকাল তার যাওয়াটা ছিল ভিন্নরকমের। তার সব প্রিয় মানুষরা ছিলেন। কিন্তু তিনি নিথর দেহে শুয়ে আছেন। শেষবারের মতো রুবেলের মরদেহ দেখতে গতকাল শিল্পকলায় এসেছিলেন তার প্রায় সব সহকর্মীরা। আর এটাই ছিল শেষবারের মতো রুবেলের শিল্পকলা ভ্রমণ।
গত বুধবার সন্ধ্যায় নিজের অভিনীত সিনেমা ‘পেয়ারার সুবাস’র বিশেষ প্রদর্শনী দেখতে এসে মারা গেছেন তিনি। তার আকস্মিক মৃত্যুতে হতবাক, স্তব্ধ গোটা শোবিজ অঙ্গন। আহমেদ রুবেলের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা প্লাজায় আনা হয়েছিল তার মরদেহ। ঢাকা থিয়েটারের উদ্যোগে আয়োজিত এই শ্রদ্ধা নিবেদন সকালে হাজির হন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, রামেন্দ্র মজুমদার, মামুনুর রশীদ চিত্রনায়িক ও ঢাকা ১০ আসনের সংসদ সদস্য ফেরদৌস আহমেদ, অভিনেতা ফারুক আহমেদ, আহসান হাবিব নাসিম, রওনক হাসান, শ্যামল মাওলা, আহসানুল হক মিনু, বৃন্দাবন দাশ, অভিনেত্রী দীপা খন্দকার, তানভীন সুইটি, জাকিয়া বারি মম, জ্যোতিকা জ্যোতি, তারিন জাহান, দিলরুবা দোয়েল, নাজিয়া হক অর্ষা, পরিচালক শাহ আলম কিরন, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, সালাউদ্দিন লাভলুসহ নাটক-সিনেমা অঙ্গনের অনেক তারকাশিল্পী।
তারা অভিনেতার প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, আবার শেয়ার করেছেন টুকরো স্মৃতিও। অশ্রু জড়ানো কণ্ঠে সেসব বলে রুবেলের আত্মার প্রতি শান্তি কামনা করেছেন। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘অত্যন্ত অকালে চলে গেল রুবেল। অভিনয় শিল্পে তার আরো অনেক কিছু দেওয়ার ছিল। ঢাকা থিয়েটারের অনেকে অকালে চলে গেছেন, তার মধ্যে হুমায়ুন ফরীদি, সেলিম আল দীনও আছেন। আমরা সবাইকে স্মরণ করি। আমার নির্মিত ‘গেরিলা’ ছবিতে শহীদ আলতাফ মাহমুদের চরিত্রে অভিনয় করেছিল রুবেল। সেই স্মৃতিগুলো আজও মনে ভাসে। এত দারুণ অভিনয় করেছিল যে, আলতাফ মাহমুদ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন। নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এটা এত বড় আকস্মিকতা। যে প্রসঙ্গে কথা বলতে একেবারেই ইচ্ছে করে না। আমাদের চেয়ে বয়সে কত ছোট, সুস্থ, এত পথ গাড়ি ড্রাইভ করে এলো।
তারপর কী হলো! আমাদের ছেড়েই চলে গেল। আমাদের একটু সুযোগও দিলো না, সেবা করার। তার সঙ্গে বহু কাজ করেছি। অভিনয় করেছি একসঙ্গে, আমার লেখা দীর্ঘ ধারাবাহিকে কাজ করেছে। তার অভিনয় জীবন আরও দীর্ঘ হতে পারত। আরো অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে পারত। কিন্তু কীভাবে কী হয়ে গেল। আমাদের কাছে রয়ে গেল জীবন্ত রুবেলের বিনিময়ে শুধু তার স্মৃতি।’ ফেরদৌস আহমেদ বলেন, আজ এমন একটি মূহুর্ত যে কথা বলার মত পরিস্থিতি নেই। অসময়ে চলে গেলেন রুবেল ভাই। তিনি অসাধারণ অভিনেতা, অসাধারণ একজন মানুষ। আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে কিন্তু অসময়ে চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া যায় না। ‘পেয়ারার সুবাস’ প্রিমিয়ারে আমার যাওয়ার কথা ছিলো। সংসদ অধিবেশনের জন্য যেতে পারিনি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তার সঙ্গে কয়েকটি ছবিতে কাজ করার। রুবেল ভাইয়ের সরলতা ও অসাধারণ অভিনয় আমাকে সব সময় মুগ্ধ করেছে। তার সঙ্গে কাটানো সময়গুলো আসলে ভোলার নয়। তিনি যেখানেই থাকবেন ভালো থাকবেন।’ নির্মতা অমিতাভ রেজা অবশ্য একটু ভিন্ন বার্তা দিয়েছেন। অমিতাভ রেজা বলেন, ‘রুবেল ভাই অসাধারণ অভিনেতা, অসাধারণ ভয়েস আর্টিস্ট। কিন্তু রুবেল ভাই একজন নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলেন। এক সপ্তাহ আগেও আমরা কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, সহযাত্রীদের পাশে থাকেন এবং ধূমপান বন্ধ করুন, সব ধরনের নেশাদ্রব্য থেকে দূরে থাকুন। সাম্প্রতিক সময়ে যারাই মারা গেছেন, সকলেরই এটা প্রধানতম কারণ ছিল। এটা এখানে বলা হয়তো উচিত না। কিন্তু আমি চাই না, এরকম দুঃখ আমাদের আরো বাড়ুক।’ অভিনয়শিল্পী সংঘের নেতা-সদস্যদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সংগঠনটির সভাপতি ও অভিনেতা আহসান হাবিব নাসিম। তিনি বললেন, ‘এটা সত্যি যে, আমরা একজন অসামান্য শিল্পীকে হারালাম। যার আরো অসাধারণ সব চরিত্রে কাজ করার কথা ছিল। যিনি সবসময় অভিনয় নিয়েই ছিলেন। এমন একজন মানুষ সবাইকে হঠাৎ স্তব্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করি।’ অভিনেত্রী তানভীন সুইটি বলেছেন, রুবেল ভাই আমার সহশিল্পী ছিলেন। প্রচুর কাজ করেছি তার সঙ্গে। তিনি শুধু একজন গুণী অভিনেতাই নন, একজন ভালো মানুষ। শুটিং এলে বাড়তি কথা বলতেন না, শুধু নিজের চরিত্রে থাকতেন।
তাকে বলতাম, নিজের যত্ন নিন। তিনি শুধু বলতেন, ‘হবে হবে’! কী হলো! সবাইকে বলব, তার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আমিও তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। ‘পেয়ারার সুবাস’ সিনেমার প্রযোজক শাহরিয়ার শাকিল বলেন, সবসময় দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘পেয়ারার সুবাস’ কবে আসছে? অথচ আজ ছবিটা আসছে, তিনি নেই। সম্প্রতি তিনি আমাদের অফিসে এসেও একটি প্রেসমিটে সবাইকে ছবিটা দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। তার প্রয়াণে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি একজন গুণী মানুষকে হারাল। ছবিটির আরেক প্রযোজক রেদওয়ান রনি বলেছেন, রুবেল ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক আগের।
সহকারী পরিচালক হিসেবে পথচলার শুরুর দিকেই তাকে সেটে পেয়েছি। আমার নির্মিত ধারাবাহিক ‘এফএনএফ’-এ তাকে পেয়েছি। তিনি এরকম একজন অভিনেতা, যাকে অদ্ভুত সব চরিত্রে মানিয়ে যায়। তার চেহারা, কণ্ঠস্বর; এটা সচরাচর হয় না। আমি একটা বিষয় ভাবছিলাম, আর দুইটা ঘণ্টা পরে কি হতে পারত না! তার ছবিটা সবাই দেখছে, দর্শকের উচ্ছ্বাসটা তিনি দেখে যেতেন। আমাদের ছবিটা রুবেল ভাইকে উৎসর্গ করা হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দুপুর ১টায় আহমেদ রুবেলের মরদেহ নিয়ে যাওয়া চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। সেখানেও তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে এবং অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রথম জানাজা। এরপর অভিনেতার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে গাজীপুরে, স্থায়ী ঠিকানায়। সেখানেই পারিবারিক কবরস্থানে তাকে আসরে নামাজের পর দাফন করা হয়।