গানে গানে রুনা লায়লার ছয় দশকের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিনোদন প্রতিবেদক
বাংলাদেশের গর্ব উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার রুনা লায়লা তার সঙ্গীত জীবনের ষাট বছর আজ পূর্ণ করলেন। বিগত ষাট বছর যাবত তিনি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে বহু গানে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতা দর্শককে গানে গানে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। জীবনে কখনো কোনো কারণে তিনি গান থেকে নিজেকে বিরত রাখেননি। সেই যে আজ থেকে ষাট বছর আগে শুরু হয়েছিলো গানের ভুবনে পথচলা, এখনো তা অবিরাম চলছে। বরং এখন গান গাওয়ার পাশাপাশি গানের সুরও করছেন, প্রতিনিয়তই সুরের মধ্যে মগ্ন থাকছেন তিনি। রুনা লায়লা জানান, সিনেমার গানে তার যাত্রা শুরু হয় শওকত আকবর, খলিল, শর্মিলী আহমেদ অভিনীত ‘জুগনু’ (বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনার সিনেমা) সিনেমাতে ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি ভাইয়া কী পেয়ারি’ গানটি গাওয়ার মধ্যদিয়ে। গানটি লিখেছিলেন তিসনা মেরুতি, কম্পোজ করেছিলেন মানজুর। ১৯৬৪ সালের ২৪ জুন মাত্র বারো বছর বয়সে ‘জুগনু’ সিনেমার এই গানে কণ্ঠ দেন রুনা লায়লা। সেই হিসেবেই আজ তিনি পেশাগতভাবে তার সঙ্গীত জীবনে ষাট বছর পূর্ণ করেছেন। আশরাফ আলী খান প্রযোজিত সিনেমাটি পরিচালনা করেছিলেন মামনুন খান। এই সিনেমাতে রুনা লায়লার বড় বোন দীনা লায়লাও প্লে-ব্যাক করেছিলেন। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৬৮ সালের ২৯ মার্চ। এরপর পাকিস্তানের আরো বহু সিনেমায় রুনা লায়লা প্লে-ব্যাক করেছেন।
যার মধ্যে বিশেষখভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘হাম দোনো’, ‘রিশতা হ্যায় পেয়ার কা’, ‘কমাণ্ডার’, ‘আন্দালিব’, ‘নসীব আপনা আপনা’, ‘দিল অউর দুনিয়া’, ‘ উমরাও জান আদা’, ‘আনমোল’, ‘নাদান’, ‘দিলরুবা’সহ আরো বেশ কিছু সিনেমায় তিনি প্লে-ব্যাক করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আগেই রুনা লায়লা প্রথম বাংলাদেশের সিনেমায় প্লে-ব্যাক করেন প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে তুমুল জনপ্রিয় গান ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’ গানটি। ১৯৭০ সালের ২৯ মে মুক্তিপ্রাপ্ত নজরুল ইসলাম পরিচালিত সিনেমা ‘স্বরলিপি’ সিনেমার এই গান লিখেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুর করেছিলেন সুবল দাস। গানে লিপসিং করেছিলেন চিত্রনায়িকা ববিতা। প্রথম প্লে-ব্যাকেই ব্যাপক সাড়া ফেলেন রুনা লায়লা। বাংলাদেশের সিনেমার গানেও তার কণ্ঠের কদর বেড়ে যায়। এরপর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এসে তিনি একে একে ‘জীবন সাথী’, ‘টাকার খেলা’, ‘জিঘাংসা’, ‘আলো তুমি আলেয়া’, ‘লাভ ইন সিমলা’, ‘প্রতিনিধি’, ‘কাজল রেখা’, ‘রং বেরং’, ‘দি রেইন’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘সুন্দরী’, ‘দি ফাদার’, ‘কসাই’, ‘দেবদাস’, ‘এক্সসিডেন্ট’, ‘চাঁদনী’, ‘দোলনা’ ,কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘অন্ধপ্রেম’, ‘দোলা’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘বিক্ষোভ’, ‘প্রিয়া তুমি সুখী হও’, ‘পাঙ্কু জামাই’, ‘দুই দুয়ারী’সহ আরো বহু সিনেমায় তিনি প্লে-ব্যাক করে শ্রোতা দর্শককে মুগ্ধ করেছেন। বাংলা ভাষায় তার বহু আধুনিক জনপ্রিয় গানও রয়েছে। যারমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হচ্ছে ‘যখন থামবে কোলাহল’, ‘পাখি খাঁচা ভেঙে উড়ে গেলে’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর’, ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম’, ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যর আগে’, ‘ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছো প্রাণ’, ‘শেষ করোনা শুরুতে খেলা’ ইত্যাদি। রুনা লায়লা ‘দি রেইন’, ‘জাদুর বাঁশি’, ‘অ্যাক্সিডেন্ট’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘দেবদাস’, ‘প্রিয়া তুমি সুখী হও’, ‘তুমি আসবে বলে’ সিনেমাতে প্লে-ব্যাকের জন্য সেরা গায়িকা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। রুনা লায়লা তার স্বামী প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা আলমগীর পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ সিনেমাতে প্রথম সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সিনেমায় তার সুর করা গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আঁখি আলমগীর। গানটি লিখেছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। প্রথম গানেই সুরকার হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। এরপর তার করা সুরে আধুনিক গান করেন আঁখি আলমগীরসহ এই প্রজন্মের লুইপা, হৈমন্তী। রাজা ক্যাশেফের সঙ্গীতায়োজনে গানগুলো ধ্রুব মিউজিক স্টেশন’ থেকে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে রুনা লায়লারই সুর করা গানে কণ্ঠ দেন ভারতের গর্ব সঙ্গীতশিল্পী আশা ভোসলে, হরিহরণ, আদনান সামী, রাহাত ফতেহ আলী। তারা সবাই বাংলা ভাষায় গান গেয়েছেন। রুনা লায়লা জানান, এখনো তিনি নতুন নতুন গানের সুর করছেন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে। ১৯৮২ সালে ‘হিজ মাস্টার ভয়েজ’ থেকে বাপ্পী লাহিড়ীর কম্পোজিসনে প্রকাশ পায় ‘সুপার রুনা’ অ্যালবামটি। এই অ্যালবামের শৈলী সাইলেন্দ্র্র’র লেখা ‘শোনো শোনো মেরি ইয়ে কাহানি’, অনজনের লেখা ‘হাইয়া হো’, ‘দে দে পেয়ার দে’ গানগুলো শ্রোতা মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। রুনা লায়লা হিন্দি সিনেমাতেও প্লে-ব্যাক করেছেন। ‘এক সে বারকার এক’, ‘ জান-এ বাহার’, ‘ইয়াদগার’, ‘ঘর দুয়ার’, ‘অগ্নিপথ’, ‘স্বপ্ন কা মন্দির’সহ আরো বেশকিছু সিনেমায় তিনি প্লে-ব্যাক করেছেন। ‘দামাদাম মাসকালান্দার’ গানটি এর আগে বিভিন্ন শিল্পী গেয়েছেন। তবে ভারতে একটি অনুষ্ঠানে রুনা লায়লা গাওয়ার পর ভীষণ সাড়া পড়ে। তারপর থেকে যেন এই গান হয়ে ওঠে রুনা লায়লারই গান। যখন যেখানে গিয়েছেন তিনি সেখানেই তাকে এই গান এবং সাধের লাউ গানটি গাইতেই হয়েছে। সঙ্গীত জীবনে চলার পথে সফলতার ষাট বছর প্রসঙ্গে রুনা লায়লা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া যে আমি এখনো গান গাইতে পারছি, সুর করতে পারছি। তারচেয়েও বড় কথা আমারই সঙ্গীত জীবনের চলার পথের সফলতার ছয় দশক আমি নিজের চোখে উপভোগ করে যেতে পারছি। এটা যে কতো বড় সৌভাগ্যের বিষয়, জীবনে কতো বড় যে প্রাপ্তি তা আসলে ভাষায় প্রকাশের নয়। আমার বাবা-মা, আমার পরিবার আমাকে শুরু থেকেই ভীষণ সহযোগিতা করে এসেছেন। রুনা লায়লা বাংলাসহ হিন্দি, উর্দু, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালীয়, স্প্যানিস, ফরাসি, ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অর্থাৎ ১৮টি ভাষায় গান গেয়েছেন। রুনা লায়লা গানে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তিনশ’রও বেশি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এদিকে আজ দুপুর ১২.৩০ মিনিটে চ্যানেল আইতে অনন্যা রুমার প্রযোজনায় রুনা লায়লাকে নিয়ে সরাসরি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার হবে। অনুষ্ঠানে ইমরান, ইউসুফ, লুইপা, ঝিলিক, কোনালসহ আরো বেশ কয়েকজন শিল্পী সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। জুগনু সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক মানজুর সাহেব আমাকে কীভাবে সিনেমায় গান গাইতে হয় তা টানা একমাস শিখিয়েছেন। এটাই আমার সারা জীবনের জন্য ভীষণ কাজে লেগেছে। এরপর আমি অনেক বড় বড় গুণী সঙ্গীত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছি। আমি ভীষণ ভাগ্যবতী যে, আমি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এখনো গান গাইতে পারছি, সুর করছি, এটাই অনেক বড় বিষয়।’