রাজনৈতিক পরিচয়ে সংকটে শিল্পীরা
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিনোদন প্রতিবেদক
শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এরপর ক্ষমতার পালাবদলে পরিবর্তন হতে দেখা যাচ্ছে অনেক কিছু। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে সংকটে পড়েছেন অভিনয়শিল্পীরাও। সরকার পতনের পর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না অনেক তারকা অভিনয়শিল্পীর, সোশ্যাল মিডিয়াতেও নেই বেশির ভাগ শিল্পীর কার্যক্রম। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হামলার শিকারও হয়েছেন কয়েকজন। ২০১৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও দলের হয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রাচী। জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনে ১৫ আগস্ট একাই যাবেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। ১৪ আগস্ট বিকালেই তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনের সামনে হাজির হন। এ সময় আরো ৭০-৮০ জন সংস্কৃতিকর্মী রোকেয়া প্রাচীর সঙ্গে যোগ দেন। সন্ধ্যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের বাইরে স্মৃতিফলকে মোমবাতি প্রজ্বালন করেন তারা। একপর্যায়ে রোকেয়া প্রাচীর ওপর হামলা চালানো হয়। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রোকেয়া প্রাচী দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। তার সে পরিচয়ের কারণে সোশ্যাল মিডিয়াতেও নানা কটাক্ষ শুনতে হয়েছে তাকে। একই রাতে অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার বাড়িতে হামলা চালিয়েছে বেশ কয়েকজন।
খবরটি নিশ্চিত করেছেন অভিনেতা সাজু খাদেম ও অভিনেত্রী বিজরী বরকতুল্লাহ। তারা জানান, বাড়িতে হামলা হলেও নিরাপদে আছেন সুবর্ণা মুস্তাফা। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে সংরক্ষিত মহিলা আসন-৪-এর প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা। এদিকে ৫ আগস্টের পর থেকে খোঁজ নেই অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদের। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করে ঢাকা-১০ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। গুঞ্জন আছে, এই মুহূর্তে ভারতে আছেন ফেরদৌস। অনেকের ধারণা, দেশেই আছেন তিনি। ফেরদৌসের মতো আত্মগোপনে আছেন চিত্রনায়ক রিয়াজও।
রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার খবর না মিললেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সামনের সারিতেই দেখা যেত এই অভিনেতাকে। একই অবস্থা আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও সংগীতশিল্পী মমতাজের। তারও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ২০০৮ সালে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এবং ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এদিকে ১৩ আগস্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন শমী কায়সার। বেশ কয়েক বছর ধরে অভিনয় থেকে দূরে থাকা শমী কায়সার ব্যস্ত ছিলেন ব্যবসা ও রাজনীতি নিয়ে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনি।
রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের সমর্থনে কথা না বলায় রোষানলে পড়েছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। মায়ের অসুস্থতার কারণে ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন না জানানোর পরেও অভিনেতার দিকে ধেয়ে আসে নেতিবাচক মন্তব্য। শিল্পীদের ওপর হামলা ও আক্রোশের প্রতিবাদ করেছেন অনেক শিল্পী। রাজনৈতিক পরিচয় নয়, শিল্পীদের বিচার করা উচিত তাদের কাজ দিয়ে এমনটাই মনে করেন অনেকে। তবে কেউ কেউ আবার বলছেন, শিল্পীদের নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ না করাই ভালো। অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম বলেন, ‘সক্রিয় রাজনীতি শিল্পীদের কাজ নয়। শিল্পী তার শিল্পকর্মটা ঠিকমতো করবেন। এটাও ঠিক, মানুষ যখন কোনো রাষ্ট্রে বসবাস করেন, তিনি নিরপেক্ষ হতে পারেন না।
কোনো না কোনো পক্ষের প্রতি তার সমর্থন থাকেই। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যেন অন্ধের মতো না হয়। শিল্পীরা মানুষের জন্য কথা বলবেন, সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবেন। রাজনীতির কারণে শিল্পী অন্ধ হলে পথ দেখাবেন কে।’ অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা বলেন, ‘আমরা একটা নতুন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় আগে কখনো দেখিনি।
এখন আমাদের ধৈর্যশীল হতে হবে। আমরা এখন আর কোনো বিভক্তি চাই না। কে কখন কী কথা বলেছেন, সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের সামনের কথা ভাবতে হবে। পেছনের কথা ভাবলে এখন চলবে না।’
অভিনেত্রী রুকাইয়া জাহান চমক বলেন, ‘শিল্পীদের রাজনৈতিক ট্যাগ থাকা উচিত নয়। তারা সব মানুষের। কিন্তু অনেকেই রাজনৈতিক ট্যাগ ব্যবহার করে সুযোগ নিয়েছেন। শিল্পীদের এমন করা উচিত নয়। এখন দ্রুত শিল্পীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা উচিত। যে কমিটি আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন রক্ষায় কাজ করবে। মূলধারার শিল্পী, যাদের কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই, তাদের নিয়ে কমিটি গঠন করা উচিত।’
এ বিষয়ে নির্মাতা সৈকত নাসির ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শিল্পীদের রাজনৈতিক দর্শন, ভিন্নমত, ভিন্ন আদর্শ থাকতেই পারে। এটি সবার নাগরিক অধিকার। তাই বলে দল ক্ষমতাচ্যুত হলেই তাদের ওপর আক্রমণ করতে হবে? এটা কোনো সভ্য রাজনীতি? চলচ্চিত্রের অনেক শিল্পী আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, যা একেবারেই কাম্য নয়। এই শিল্পীরাই আপনাদের বিনোদিত করেছেন, আপনাদের ভালোবাসায় তারা পরিচিতি পেয়েছেন। অন্তত সেই সব কথা মাথায় রেখে ক্ষমা করতে শিখুন।’ নির্মাতা কবিরুল ইসলাম রানা লিখেছেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে এ দেশে শিক্ষক, ডাক্তার, পরিচালক, শিল্পী তাদেরও রাজনৈতিক পরিচয় লাগে। দলের সাপোর্ট করেন সমস্যা নাই, শুধু দলকানা হয়েন না। এর পরিণতি সবাই দেখছি। আমরা অবশ্যই রাজনীতি করব, সাপোর্ট করব কিন্তু তারও লিমিটেশন থাকা উচিত। সব সরকার আমাদের ব্যবহার করতে চাইবে কিন্তু আমাদেরও বোঝা উচিত, কতটা আমরা ব্যবহার হব।’