আজ বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের নন্দিত-জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কনকচাঁপার জন্মদিন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই গুণী সঙ্গীতশিল্পী নিজেকে সবসময় একজন কণ্ঠশ্রমিক হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েই তিনি শ্রোতা দর্শকের ভালোবাসার কনকচাঁপায় নিজেকে পরিণত করেছেন। ১৯৯৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশে যতগুলো ছবি হয়েছে প্রায় সবগুলো ছবিতেই ছিল কনকচাঁপার কণ্ঠের উপস্থিতি। বিশেষ করে শাবনূরের ছবি মানেই ছিল কনকচাঁপার গান। শাবনূরের কণ্ঠের সঙ্গে কনকচাঁপার কণ্ঠের অনেকটা সাদৃশ্যতার কারণেই সে সময় কনকচাঁপাকে দিনে চার/পাঁচটি গানও রেকর্ড করতে হয়েছে। গুণী এই সঙ্গীতশিল্পীর এবারের জন্মদিন নিয়ে নেই কোনো উচ্ছ্বাস। নেই কেক কাটাকাটি-এমনটাই জানালেন তিনি। নিজের জীবনের সেরা জন্মদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কনকচাঁপা বলেন, ‘আমার দাদার নিয়মিত তিনটি খরচের হিসেবের খাতা ছিল। সেই হিসেবের খাতার একটি আমি দাদীর কাছ থেকে নিয়েছিলাম। সেখানে একটি স্থানে লেখা ছিলো তারপর আজিজা অর্থাৎ আমার দাদী অসুস্থ হলেন। ১৯৩৩ সাল, ২৭ অক্টোবর, গত সোমবার, আমার তৃতীয় খোকার জন্ম হইলো, লেপের তোলা ৭ আনা। এভাবে আমি আমার বাবার জন্ম সাল, তারিখ বের করেছিলাম যা বাবার কখনোই জানা ছিল না। বিগত ২০ বছরেরও আগের ঘটনা এটি। তখন আমার আমার বাবা আমার এক জন্মদিনে এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি একটি কাগজে লিখেছিলেন তুমি আমার মেয়ে এটা সত্য কিন্তু তুমি আমাকে আবিষ্কার করেছো আমার জন্ম সাল তারিখ খুঁজে বের করে। এ যেন মেয়ের পেটে বাবার জন্ম। বাবার এই কথাটা আমার আজীবন মনে থাকবে।’ কয়েক বছর আগে কনকচাঁপার জন্মদিনে তার ছেলে মাশুক তার চাকরির একমাসের বেতনের পুরো টাকাটা তাকে দিয়েছিলেন। ছেলের কষ্টের সেই টাকা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন তিনি বারবার। এটা মা হিসেবে কনকচাঁপার অনেক আবেগ জড়ানো শান্তির একটি বিষয় ছিল। ২০১৬ সালে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে কনকচাঁপা’র প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী ‘দ্বিধার দোলাচল’ সফলতার সঙ্গে শেষ হয়। ‘দ্বিধার দোলাচলকে ঘিরে তার মনের গহীন কোনে জমা রয়েছে টুকরো টুকরো ভালোবাসার গল্প। দ্বিধার দোলাচল’ উদ্বোধন আলোকিত মানুষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইয়াীদ। কনকচাঁপা তার আঁকা ছবিগুলোর জন্য প্রশংসিত হচ্ছিলেন গ্যালারিতে আসা দর্শকের কাছ থেকে। প্রদর্শনীটি উৎসর্গ করা হয়েছিলো প্রয়াত চিত্রশিল্পী ও পরিচালক খালিদ মাহমুদ মিঠুকে। কনকচাঁপার সর্বশেষ একক এ্যালবাম ছিলো ‘পদ্মপুকুর’ যা লেজার ভিশন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। আলাউদ্দিন আলীর সুরে ‘বিধাতা’ চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার মধ্যদিয়ে একজন প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে কনকচাঁপার যাত্রা শুরু হয়। এরপর দ্বিলীপ বিশ্বাসের ‘অস্বীকারসহ আরো বেশ কিছু চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেন। কিন্তু বেশ কিছুটা সময় পর সালমান শাহ-শাবনূরের প্রথম চলচ্চিত্র ‘তুমি আমার’-এ আবু তাহেরের সুরে ‘দেখা না হলে একদিন, কথা না হলে একদিন এবং তুমি আমার ভালোবাসার গান’ এই দুটি গানে আগুন এবং শেখ ইশতিয়াকের সঙ্গে কনকচাঁপা তার গায়কীর শৈল্পিকরূপ দিয়ে এদেশের গানপাগল মানুষের মাঝে আলোড়ন সুষ্টি করেন। এই দুটি গানই কনকচাঁপার জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের রচনা করে। গান দুটি সুপার ডুপার হিট হয়ে যাবার কারণে সে সময়ের সফল চলচ্চিত্র নির্মাতার খুঁজতে শুরু করেন কনকচাঁপাকে। একসময় খুঁজে পাওয়া গেলা তাকে। এরপর পরই দেশীয় চলচ্চিত্রে শুরু হলো প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে কনকচাঁপার এক ভিন্ন অধ্যায়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মা মোমেনা জাহানের গর্ভে জন্ম নিল এক কন্যাশিশু। যিনি বড় হয়ে বাংলা সংগীতের এক জীবন্ত কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী হয়ে উঠলেন। তার পুরো নাম রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা। বাবা আজিজুল হক মোর্শেদের কাছেই প্রথম সংগীতের হাতেখড়ি। তার পর বাংলা সংগীতের মহারথী প্রয়াত সংগীতশিল্পী বশীর আহমেদ এবং স্বনামধন্য সুরকার (স্বামী) মইনুল ইসলাম খানের কাছে সংগীতে তালিম নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন এই সুরের পথিক। চলচ্চিত্র, আধুনিক গান, নজরুলসংগীত, লোকগীতিসহ প্রায় সব ধরনের গানে তিনি সমান পারদর্শী। ২০২০ সালের জন্মদিনে কনকচাঁপাকে জন্মদিনের উপহার স্ববরূপ এই প্রজন্মের পাঁচজন সঙ্গীতশিল্পী তারই গাওয়া গান গেয়ে উপহার দিয়েছিলেন। কনকচাঁপার যে পাঁচটি গান এই প্রজন্মের পাঁচজন শিল্পী নিজেদের কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন সে গানগুলো হচ্ছে ‘আমি নই সেই বনলতা সেন’ (লেখা সেজান মাহমুদ, গেয়েছিলেন ঝিলিক), ‘আজ আর কোনো চাওয়া নেই’ (লেখা নজরুল ইসলাম বাবু, গেয়েছিলেন সালমা), ‘এলোমেলো চুল আর ললাটের ভাঁজ’ (লেখা সেজান মাহমুদ, গেয়েছিলেন হৈমন্তী), ‘তুমি তো দূরের এখন’ (লেখা কবির বকুল, গেয়েছিলেন লুইপা), ‘ঐ পতাকা আমার মায়ের মুখের মতো’ (লেখা কবি কাজী রোজী, গেয়েছিলেন রন্টি দাস)। প্রত্যেকটি গানের সুর সঙ্গীত করেছেন মইনুল ইসলাম খান। করোনার কালে শিল্পীরা নিজেদের সাধ্যমতো সুরকারের সাহায্য ছাড়াই নিজেদের কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন। ২০১০ সালের একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ পায় কনকচাঁপার প্রথম আত্মকথনমূলক প্রবন্ধ ‘স্থবির যাযাবর’। এদিকে কনকচাঁপার জন্মদিন উপলক্ষ্যে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার ভবেরচর-এ অবস্থিত কাজী হাসানের‘ সোনারং তরুছায়ার কনকচাঁপা চত্ত্বরের বাগান বিলাস ফুল গাছের বেদিতে আল্পনা এঁকেছে নবম শ্রেণির ছাত্রী মারিয়া ইসলাম। কনকচাঁপার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘তুমি আমার এমনই একজন’, ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে’, ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’, ‘ছোট্ট একটা জীবন নিয়ে পৃথিবীতে কেন বলো আসা’, ‘তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘আমার নাকেরই ফুল বলে যে তুমি যে আমার’, ‘এমন একটা দিন নাই’, ‘কোন কাননের ফুলগো তুমি’, ‘বিধাতা গড়েছে আমাকে’, ‘চোখের ভেতর স্বপ্ন থাকে’, ‘প্রেমের তাজমহল’, ‘এতো ভালো বেসোনা আমায়’, ‘সাথী তুমি আমার জীবনে’, ‘তোমাকে ছেড়ে আমি কী নিয়ে থাকবো’, ‘আর যেন ভুল না হয়’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে’, ‘কতো মানুষ ভবের বাজারে’, ‘একদিন তোমাকে না দেখলে কষ্ট হয়’, ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনিতো দাম’, ‘কতো মানুষের ভবের বাজারে’ ‘অনেক সাধনার পরে আমি’, ইত্যাদি।