ঢাকা ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

ফসলি জমি ও নদী ধ্বংসের আশঙ্কা

ফসলি জমি ও নদী ধ্বংসের আশঙ্কা

বায়ুদূষণে ঢাকার পরেই বরিশাল বিভাগের অবস্থান। অথচ এ বিভাগেই পরিবেশ ধ্বংস করে বরগুনা তালতলী উপজেলায় ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে চীনের পাওয়ার চায়না রিসোর্স লিমিটেড ও বাংলাদেশের আইসোটেক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইসোটেক ইলেকট্রিফিকেশন কোম্পানি লিমিটেড। এতে ওই এলাকার কৃষি জমি, নদী ও বনাঞ্চল ধ্বংসের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মধ্যদিয়ে বনাঞ্চল উজাড়, পায়রা ও বিশখালী নদীতে ইলিশ প্রজনন কেন্দ্র নষ্ট করা হয়েছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় সচেতন নাগরিক সমাজ। এছাড়াও কয়লার কঠিন ও তরল বর্জ্য নদীর পানিতে গিয়ে মিশবে। এতে নদীর পানিসহ আশপাশের এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে নষ্ট হবে। নদীপাড়ের খোট্টার চরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে এই নদীতে কয়লাবাহী জাহাজ নিয়মিত আসবে। এতে নদীর পানি শুধু উত্তপ্তই হবে না দূষিতও হবে। যার বড় ধরনের প্রভাব পরবে ইলিশের ওপর। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সুন্দরবন নামে পরিচিত টেংরাগিরি বনও রয়েছে মাত্র ১ থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যে।

জানা গেছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে চীন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, বিদেশে আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে না দেশটি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিরূপ প্রভাব রোধে প্যারিস চুক্তি অনুসারে কার্বন নিঃসরণ কমাতে চাপ রয়েছে চীনের ওপর। এ বিষয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং বলেছিলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও কার্বন নিঃসরণ কম হয় এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে উন্নয়শীল দেশগুলোকে অর্থ সহায়তা করবে চীন। চীনের বাইরে অন্য কোনো দেশে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অর্থায়ন করবে না তার দেশ। অথচ চীনা প্রকৌশলীরা বাংলাদেশে এসে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছেন।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চললে পরিবেশ দূষণ হবে, এটা স্বাভাবিক। তবে কয়লার গুণগত মান ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশ ঠিক থাকলে পরিবেশ দূষণ কমবে। একই কথা বলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) প্রাইভেট জেনারেশনের (আইপিপি/পিপিপি) পরিচালক এবিএম জিয়াউল হক। তিনি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বহু আগেই চীন সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে নীতিগতভাবে সরে এসেছে। দেশটি দিনের বেলায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে রাতে চালাচ্ছে। অথচ চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে এসে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। আর বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানির ৩০৭ মেগাওয়াট কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা চালানো হতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরগুনায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ‘বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড’ নামে পরিচালিত হবে। কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কিনবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের পরিবর্তে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করছে সরকার। এই পরিকল্পনার মধ্যেই আজকে বরিশালে কয়লাভিত্তিক ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসতে যাচ্ছে। এতে বায়ুদূষণ কিছুটা হলেও বাড়বে।

এ বিষয়ে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, চীনের কিছু সুবিধাভোগী সাব-কন্ট্রাক্টর বাংলাদেশে আছে। তারা চীনের বিভিন্ন মেয়াদোত্তীর্ণ যন্ত্রপাতি এনে বাংলাদেশে ব্যবসা করছেন। অন্যদিকে সরকারের মধ্যেই কিছু কমিশন ভোগী রয়েছেন, যার কারণেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রত্যেকটি প্রকল্পের পেছনে কমিশন রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় একটি কমিশন ভোগী প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রণালয়টি পরিবেশ ধ্বংস করে কমিশন পাচ্ছে। যে প্রকল্পে যতবেশি কমিশন, সেই প্রকল্প তত দ্রুত অনুমোদন পায়। এতে বাংলাদেশর কতটা ক্ষতি হল, সেটি মুখ্য বিষয় নয়, কমিশনটাই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীন সরকার নীতিগতভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে চীনা প্রকৌশলীরা বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে কেন এমন প্রশ্নে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরো বলেন, চীনকে রাজনৈতিকভাবে খুশি রাখতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. আনসারুল করিম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে, সেখানে বাংলাদেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও যাতে পরিবেশের ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরও বলছে, প্রকল্পের কারণে বনসহ আশপাশের পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। এ রকম আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। প্রসঙ্গত, বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কোম্পানি ২০১৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত