সময়ের স্রোতে ভেসে গেল আরও একটি বছর। নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বিদায় নিল ২০২২ সাল। বিদায়ি বছরে ক্ষমতায় থেকেও রাজপথে ছিল আওয়ামী লীগ। গেল বছরটি আওয়ামী লীগের কেমন কাটল, তার হিসাব-নিকাশ চলছে দলের ভেতর ও বাইরে। জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে গেল বছরটি শুরু হয় আওয়ামী লীগের। এরপর জুন মাসে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও জয় লাভ করে দলটি। তবে বছরের শেষে ২৭ ডিসেম্বর দলীয় কোন্দলের কারণে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির কাছে পরাজয় বরণ করেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী। পাশাপশি বিদায়ী বছরে জেলা পরিষদ নির্বাচন, সংসদ উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করতে জেলা-উপজেলায় সম্মেলন করে দলটি। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। ঢাকা মহানগরে আমাদের কখনই ইউনিট কমিটি ছিল না। এবার ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১ হাজার ৬০০’র মতো কমিটি হয়েছে। এটা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে নতুন এবং সবচেয়ে বেশি উপজেলা সম্মেলন হয়েছে গত বছর। সম্মেলনের মধ্য নিয়ে চাঙা হয়েছে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। ছাত্রলীগ, যুব মহিলা লীগ ও মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন করে নতুন নেতৃত্বের হাতে সাংগঠনিক দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এছাড়া যুবলীগের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে সারা দেশে বর্ধিত সভা করে সংগঠনটি। ১১ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ লাখ লোকের যুব মহাসমাবেশ করে যুবলীগ। এই যুব মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সর্বশেষ গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ২২তম জাতীয় কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে সারা দেশে গতিশীল হয় আওয়ামী লীগ। যদিও আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে নেতৃত্বের তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো নেতার মনে কষ্ট দিতে চাননি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তবে একেবারেই যারা বিতর্কমুক্ত নয় কিংবা বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেছেন এমন কয়েকজনকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের কমিটি সাজানো হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর আগেই নৌকার পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। ২৪ নভেম্বর যশোর, ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ও ৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারে নির্বাচনী জনসভা করেছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন পর জনসমাবেশে দলীয় প্রধানের সশরীরে উপস্থিতি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেছে। প্রতিটি সমাবেশে লাখণ্ডলাখ মানুষের উপস্থিতি ঘটে। সমাবেশ থেকে আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট চেয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বিদায়ী বছরে সরকারের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ এমপি-মন্ত্রীর বেফাস মন্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে ছিল অস্বস্তি। আধিপত্য বিস্তারের নামে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দলীয় নেতাকর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় কমপক্ষে সাতজন এমপিকে দলের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কাণ্ডারীর বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা ছিলেন।
বিদায়ী বছর ‘খেলা হবে’ স্লোগানটিও রাজনীতির মাঠে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ‘খেলা হবে’ স্লোগান দিয়েছিলেন। এরপর দলের তরুণ নেতাকর্মীদের মাঝে এই স্লোগানটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বছরজুড়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ইস্যুভিত্তিক বক্তৃতাণ্ডবিবৃতিতে সময় কাটালেও শেষ বেলায় এসে আটঘাঁট বেঁধে রাজপথে নামে বিএনপি। গত সেপ্টেম্বর থেকে বিভাগীয় সমাবেশ শুরু করে দলটি। সমাবেশগুলোয় জনসমাগম দেখে নড়েচড়ে বসে আওয়ামী লীগও। এরপর মাঠের রাজনীতিতে চাঙা ও উজ্জীবিত হয়ে উঠে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। গেল বছরে বিভিন্ন ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিল বিএনপি। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেল তাদের সেই তর্জন ও গর্জন গণমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ ছিল। ছিল পত্রিকা আর টেলিভিশনে। বিএনপি কয়েকটি বিভাগীয় সমাবেশ করার পর আওয়ামী লীগও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে । ‘১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের নির্দেশে’ বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমানের এমন বক্তব্যের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের আন্দোলন অত্যন্ত সুকৌশলে সামাল দেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলে ধরাশায়ী হয় বিএনপি। বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশলে ২০২২ সালে সফল হয় আওয়ামী লীগ।