বছরের প্রথম দিন নতুন বই হাতে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রকীবুল হক

করোনা মহামারির কারণে বন্ধ থাকার দুই বছর পর গতকাল রোববার বছরের প্রথম দিন রাজধানীসহ সারা দেশে অনুষ্ঠিত হলো বই উৎসব। এদিন স্কুলে স্কুলে উৎসবমুখর পরিবেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয় বিনামূল্যের নতুন পাঠ্যবই। এর আগে গত শনিবার বই বিতরণ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর গতকাল সকালে কেন্দ্রীয়ভাবে আলাদা দুটি স্থানে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক দিবস-২০২৩ এর উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রাথমিক ও প্রাক প্রাথমিকের বই উৎসবের আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে গাজীপুরের কাপাসিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে শুরু হয় মাধ্যমিকের বই উৎসব।

তবে এখনও ছাপা ও সরবরাহ কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় এদিন আংশিক বই দিয়ে উদ্বোধন করা হয়েছে বিতরণ কার্যক্রম। কিছু স্কুলে বই বিতরণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলেও শিক্ষার্থীদের অনেকেই বই না পেয়ে খালি হাতে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। পাঠ্যক্রম অনুযায়ী শতভাগ বই পেতে প্রাথমিকের অন্তত এক মাস আর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের এক সপ্তাহ সময় লাগবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়া বিতরণ করা অনেক বই নিম্নমানের কাগজে ছাপা নিয়েও সংশ্লিষ্টদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। আংশিক বই নিয়েই আজ নতুন বছরের ক্লাস শুরু হচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সব শিক্ষার্থীই বই পেয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষান্ত্রী ডা. দীপু মনি। গাজীপুরের কাপাসিয়ায় বই উৎসবে তিনি বলেছেন, কাগজের আর কোনো সংকট থাকবে না, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সবাই বই পেয়ে যাবে। এরইমধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ বই দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে আয়োজিত বই উৎসবে এবারের ‘বই সংকটের’ কারণ ব্যাখ্যা করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে কাগজ সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে সঠিক সময়ে পূর্ণাঙ্গ বই প্রেসগুলো দিতে পারেনি। প্রায় ৮০ ভাগ বই আমাদের দিয়েছে। আমরা এ মাসের মধ্যে সারা বাংলাদেশে শতভাগ বই দিতে পারব।

সূত্রমতে, এ বছর বই উৎসবে সারা দেশে ৪ কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৩৮১ শিক্ষার্থীর মাঝে ৩৩ কোটি ৯১ লাখ ১২ হাজার ৩০০ কপি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। যার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে ২ কোটি ১৯ লাখ ৮৪ হাজার ৮২৩ শিক্ষার্থীকে ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ২৪৫টি বই বিতরণ করা হবে।

২০১০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেয়ার কার্যক্রম শুরু করে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৪৩৪ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ২১১ কপি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে গত দুই বছর উৎসব ছাড়াই স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া হয়। গতকাল বই উৎসব শুরুর পর রাজধানী ও এর আশপাশের বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বই না পৌঁছানোয় শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে পারেনি অনেক প্রতিষ্ঠান। কোথাও কোথাও বই উৎসবের আয়োজন করা হলেও শিক্ষার্থীরা দুইয়েকটি বই নিয়ে ফিরে যায়।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার নামকরা একটি স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে সকালে মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিচ্ছেন অতিথিরা। আর অন্য শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বসিয়ে বই দেয়া হয়। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা জানান, তারা মাত্র তিনটি বই পেয়েছে। তবে যেসব বই দেয়া হয়েছে তা খুব নিম্নমানের তথা নিউজ প্রিন্ট কাগজে ছাপা বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। ফলে এসব বই বেশিদিন টেকসই হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সকাল ৮টা থেকেই ডেকে নেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। ১০টায় বই দেয়া হয়, তবে শুধু একটি করে বই পেয়েছে অনেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে ক্লাস সেভেনে উঠেছে। ওকে শুধু একটি ইংরেজি বই দিয়েছে। বাকি বই কবে দেয়া হবে সেই বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

এদিকে অনেক প্রতিষ্ঠানে একদিনে বা এক সঙ্গে বই না দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিন বা সময়ে দেয়া হবে বিনামূল্যের বই। ফলে বই বিতরণের কাজটি চলবে আরও কয়েক দিন।

বেশ কয়েকটি স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখনো সব শ্রেণির সব বই বিদ্যালয়ে পৌঁছায়নি। এজন্যই কোনো কোনো শ্রেণিতে সব বই দেয়া যায়নি। মূলত নিম্ন মাধ্যমিক স্তর ও প্রাথমিকে কয়েকটি শ্রেণিতেই এ সমস্যা হচ্ছে।

আজিমপুর সরকারি স্কুলে বই বিতরণ করা হলেও পাঠ্যক্রম অনুযায়ী দেয়া হয়নি সব বই। বিভিন্ন শ্রেণিতে দুয়েকটি করে বই দেয়া হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত প্রাথমিকের জন্য ৬ কোটি ৬৬ লাখ ১৯৫টি বই সরবরাহ করা হয়েছে। তবে মুদ্রণ সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য মতে, ২ কোটি ৮৯ লাখ ৮২ হাজার বই প্রস্তুত হয়েছে।

অন্যদিকে, এনসিটিবির পক্ষ থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৯ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার বই প্রস্তুত থাকার দাবি করা হয়েছে। কিন্তু মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সংখ্যা ১৪ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, সারা দেশে ৮০ ভাগ বই সরবরাহ করা হয়েছে। জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে সব শিক্ষার্থী পাঠ্যক্রম অনুযায়ী হাতে পাবে সব বই।

পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেরিতে চুক্তি হওয়া, মাধ্যমিকের কয়েক শ্রেণির বইয়ের ক্ষেত্রেও দেরিতে চুক্তি করা, কাগজ সংকট, পাল্প সংকট, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, পাঠ্যবই ছাপা বাদ দিয়ে নোট-গাইড ছাপানো ইত্যাদি কারণে বই ছাপতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে এনসিটিবি ও মুদ্রণ সমিতি জানিয়েছে, কাগজ সংকটের কারণে সব বই সময়মতো ছাপানো যায়নি। একই কারণে পাওয়া যায়নি ৮৫ জিএসএম মানের উজ্জ্বলতা। যার ফলে বই ছাপাতে হয়েছে নিম্নমানের নিউজপ্রিন্ট কাগজে। অনেক প্রিন্টার্স বই ছাপানোর দরপত্র নিলেও সময়মতো ছাপাতে পারেনি বই।

এদিকে গতকাল বছরের প্রথম দিনে নতুন বই তুলে দেয়া হয়েছে সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় শিক্ষার্থীদের হাতে; নতুন বই নিয়ে নতুন ক্লাসে ওঠার আনন্দে উচ্ছ্বসিত শিশুরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে প্রাথমিকের বই উৎসব: গতকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে ‘বই বিতরণ উৎসব ২০২৩’ এর উদ্বোধন করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন।

এ সময় তিনি বলেন, এ বছর ২ কোটি ১৮ লাখ ৩ হাজার ৩০ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ২৪৫টি বই বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এরইমধ্যে সব স্কুলে নতুন বই পৌঁছে গেছে। প্রেসের কারণে হয়তো দুয়েক সেট কম থাকতে পারে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে কাগজ সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে সঠিক সময়ে পূর্ণাঙ্গ বই প্রেসগুলো দিতে পারেনি। প্রায় ৮০ ভাগ বই আমাদের দিয়েছে। আমরা এ মাসের মধ্যে সারা বাংলাদেশে শতভাগ বই দিতে পারব।

শিশুদের ‘স্মার্ট নাগরিক’ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে ২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিনে বিন্যামূল্যে এ বই বিতরণ করা হচ্ছে। প্রধামমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন আমরা ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবো। সেই স্মার্ট বাংলাদেশের কারিগর আজকের এই প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা।

আমি আশা করব, আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবকরা সুন্দর মনে শিশুদের সঠিক পড়ালেখার মাধ্যমে গড়ে তুলবেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেই প্রাথমিক শিক্ষাকে আমাদের আরও উন্নত করতে হবে, মানসম্মত করতে হবে। আমরা আমাদের সন্তানদের ওইভাবে মানুষ করে দেশের জন্য কাজে লাগাতে হবে।

অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব টুর্নামেন্ট থেকে উঠে আসা সাফ চ্যাম্পিয়ন নারী ফুটবল দলের স্বপ্না রানী, সাথী বিশ্বাস, সাজেদা খাতুনসহ পাঁচ সদস্যকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান, সংসদ সদস্য বেগম শিরীন আখতার, বেগম ফেরদৌসী ইসলাম ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।