বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে ৪ বছর দুই মাস আগে নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরপর দৃশ্যত কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে দলটি। এমনকি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটেও জামায়াতের অবস্থান নড়বড়ে ও নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায়। এর মধ্যে জঙ্গিবাদের সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত ডিসেম্বর ও নভেম্বরে পৃথক সময়ে দলটির কেন্দ্রীয় আমির ডা. শফিকুর রহমান ও তার ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ফিরে আসতে দেখা গেছে তাদের।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য নিন্দিত সংগঠনটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় অতীত কাটিয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে সফল হওয়ার পর সরকারে যোগ না দিলেও পরবর্তীতে বিএনপির সঙ্গে জোট করে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তারা সরকারেও অংশ নেয়। পরবর্তীতে আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে কোনঠাসা করতে থাকে। কিন্তু দুই বড় দলের সঙ্গে বিভিন্ন সময় ‘ঘর’ করা জামায়াত বর্তমানে একঘরে হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় গত সপ্তাহে (শুক্রবার) ‘মৌচাক-মালিবাগে জামায়াতের মিছিলে বাধা দিলে পুলিশ ও জামায়াত কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হয়ে ১১ পুলিশ সদস্য হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে জামায়াতের শক্তির উৎস কি?
এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন বলে জানান। তবে গত শনিবার দুপুরে হামলায় আহত পুলিশ সদস্যদের রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে দেখতে গিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, অবৈধভাবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ করেছে। এতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পুলিশের ১১ জন সদস্য আহত হয়েছে। পরে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। হামলাকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ডিএমপি কমিশনার তখন বলেছিলেন- জামায়াতের অতীত ইতিহাস ফিরে আসুক, এটা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না। কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর আওতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছিল। দলটির নিবন্ধন নম্বর ছিল ১৪। ২০০৯ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা ৬৩০ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে আদালত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০এইচ ধারা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হলো।
কিন্তু নিবন্ধন বাতিল হওয়া একটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ভাবাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার গোলাম ফারুক বলেছেন- রাজধানীতে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর যে হামলা করেছে সেটি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। হামলাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়ার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। এভাবে বেআইনি কাজ করা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার বিষয়ে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না।
খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন- অতীতে বগুড়ায় চাঁদে সাঈদীকে দেখা নিয়ে তারা পুলিশ সদস্যদের খুন করেছে। গাইবান্ধায় আগুন দিয়েছে, পুলিশ সদস্যদের আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। অতীতে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তারই ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ঢাকায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমরা কোনোভাবেই আর মেনে নেব না। যত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার নেয়া হবে। অতীতে যে নৈরাজ্য কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল তা নতুন করে আর কোনোভাবেই ফিরতে দেয়া হবে না।
ডিএমপি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে ৮ হাজার। ডিএমপির পৃথক চার থানায় মামলাগুলো দায়ের করা হয়। এর মধ্যে চারটি পুলিশের ওপর হামলা ও একটি বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা হয়েছে। সবক’টি মামলার বাদী পুলিশ। এসব মামলায় ৩০২ জনের নাম উল্লেখসহ মোট ৮ হাজার ২০২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় বেশ ক’জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। তবে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত। ঘটনার পর অভিযোগ উঠলে তা অস্বীকার করে এক বিবৃতিতে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাছুম দাবি করেন- ‘জামায়াত পুলিশের ওপর হামলা করেছে, এ কথা ঠিক নয়। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে জামায়াতের কোনো বিরোধ নেই। সুতরাং পুলিশের ওপর হামলা করার প্রশ্নই আসে না।’ এ বিষয়ে পৃথক বিবৃতি দিয়ে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গণমিছিলের আয়োজক জামায়াতের ঢাকা মহানগরী উত্তর শাখার আমির মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন ও সেক্রেটারি মুহাম্মদ রেজাউল করিমও।