ইতিহাস-ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে সংগঠনটি। তবে, বিগত দশকে সংগঠনটির বিভিন্ন ধরনের বিতকিত কর্মকাণ্ড অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য অতীতের এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে ধরে রাখতে এবং সংগঠনকে বিতর্কমুক্ত করতে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠন পরিচালনা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সংগঠনটির নতুন নেতৃত্ব।
১৯৪৮ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপমহাদেশের বৃহৎ এ ছাত্রসংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির পতাকাবাহী এ সংগঠনের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয় ও গৌরবোজ্জ্বল। তবে বিগত এক দশক ধরে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড অতীত ইতিহাসকে মøান করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত এক দশকে বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে মোট এসেছেন ১০ জন। এদের কেউই তাদের দায়িত্ব পালনকালে দেশের সব সাংগঠনিক ইউনিটের কমিটি করতে পারেননি। সর্বশেষ দায়িত্ব থাকা ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ১১৯টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে ৭০টিতে কমিটি করতে পারেননি। চিঠির মাধ্যমে পদ বর্ধিত কমিটিকে দিয়ে তৈরি করেছেন বিতর্ক। এছাড়া প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি করে উপেক্ষা করেছেন গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতাও। এর আগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পাওয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে কমিটিতে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি, মাদকসেবী, বিএনপি-জামায়াত ও রাজাকার পরিবারের সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ, বিবাহিত, নিষ্ক্রীয় এবং অছাত্রদের রাখা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে নামে পদবঞ্চিতরা, যার ফলে বিতর্কিতদের পদ শূন্য করা হয়।
এ বিষয়ে জানার জন্য ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। আমরা সেই ইতিহাসকেই ধারণ করি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করতে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিানার চলার পথকে মসৃণ করার জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রকে মেনে চলতে হবে। আমাদের অনেক সাংগঠনিক ইউনিটের কমিটি নেই। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পরে আমরা এসব কমিটি করার উদ্যোগ নেব।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী ছাত্রলীগের কর্মসূচি : ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ছাত্রলীগ। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের ওয়ার্ডপর্যায় পর্যন্ত অনাবাদি জমিতে শাকসবজি-ফল চাষ, মাছ ও গৃহপালিত পশুপালনের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। ছাত্রলীগ বলেছে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশেই এই উদ্যোগ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বছরব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ছাত্রলীগের এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ দৃশ্যমান, লক্ষ্য এবার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, সময়ের প্রয়োজনে আজ থেকে ৭৫ বছর পূর্বে বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির মহান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বর্তমানেও সেই ছাত্রলীগ সময়ের প্রতিটি প্রয়োজনে নিজের সর্বোচ্চটুকু বিলিয়ে দেয়ার ব্রতকে ধারণ করে পথ চলছে।
এ দেশের প্রতিটি প্রজন্মে, প্রতিটি তারুণ্যে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অনুভূতিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শ্রেষ্ঠতম স্থানে অবস্থান করেছে, করছে এবং আগামীতেও অবধারিতভাবে করবে। তাই, ছাত্রসমাজ ও তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশরত্ন শেখ হাসিনার পরিকল্পিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ নেতৃত্ব দেবে ছাত্রলীগ, ৭৫তম বর্ষপূর্তিতে এটিই আমাদের সংকল্প।
কর্মসূচির বিষয়ে সাদ্দাম হোসেন বলেন, আজ বুধবার সকাল ৬টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৮টায় ধানমন্ডিস্থ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, সাড়ে ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে কেক কেটে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন আর বিকাল ৩টায় শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে।
অন্যান্য বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনই শোভাযাত্রা বের করে ছাত্রলীগ। তবে এবার ৬ জানুয়ারি শুক্রবার দুপুর আড়াইটায় হবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই শোভাযাত্রা। এর কারণ হিসেবে সাদ্দাম হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ সমুন্নত রাখা, ঢাকা শহরের যানজট, শিক্ষার্থীদের ক্লাস পরীক্ষা এবং জনজীবনের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে আমরা আমাদের র্যালিটি শুক্রবার করছি। এছাড়া ৫ থেকে ৮ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, স্বেচ্ছায় রক্তদান ও সংগৃহীত রক্ত বিতরণ আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সুবিধাজনক সময়ে বছরব্যাপী আরও যেসব কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে : ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশের ওয়ার্ডপর্যায় পর্যন্ত অনাবাদি জমিতে শাকসবজি-ফল চাষ, মাছ ও গৃহপালিত পশুপালন ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সাথে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধ ছাত্রসমাজ’ শীর্ষক মতবিনিময়, কনসার্ট ফর স্মার্ট বাংলাদেশ আয়োজন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পুনর্মিলনী, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ : গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের ৭৫ বছর’ শীর্ষক স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ, স্মার্ট বাংলাদেশ আইডিয়া কনটেস্ট, সব সাংগঠনিক ইউনিটের দলীয় কার্যালয়ে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে দেশব্যাপী ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে স্মার্ট বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক প্রতিযোগিতা ও জাতীয়ভাবে স্মার্ট ইয়ুথ ক্যাম্প আয়োজন।’
বছরব্যাপী এসব কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনে প্রতিটি সাংগঠনিক ইউনিটকে নির্দেশনা এবং ছাত্রসমাজকে নিজেদের মেধার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক।
ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মাধ্যমে আমরা একটা লড়াই করার শপথগ্রহণ করতে চাই। আর এই লড়াইয়ের শেষ আমরা দেখতে চাই। যারা জাতির পিতার হত্যাকারী, বঙ্গবন্ধু তনয়াকে হত্যার চেষ্টা করেছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে এবং যারা দুর্নীতিকে বাংলাদেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়েছে, সেই ?দুর্নীতিবাজদের যারা পুনর্বাসন করেছে, গণতন্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে যারা এরই মধ্যে মানুষ হত্যা করেছে, সেই অপশক্তির বিনাশ বাংলার মাটি থেকে আমরা নিশ্চিত করেই ছাড়ব।
তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের পলিটিক্যাল ডেথ সার্টিফিকেট নিশ্চিত না করা পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিরাপদ নয়। লাখো শহীদের রক্তের উত্তারাধিকারের প্রতি আমাদের যে স্বপ্ন রয়েছে সেই স্বপ্ন নিরাপদ নয়। আজকে আমরা প্রত্যয় ব্যক্ত করছি, ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক মৃত্যুঘণ্টা আমরা নিশ্চিত করবোই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচিত করা দেশপ্রেমের অংশ হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে পুনর্নির্বাচিত করাকে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে নির্বাচিত করা আমাদের দেশপ্রেমের অংশ হয়ে পড়েছে। এই দেশপ্রেমের অংশ হিসেবে আমরা তার গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে চাই।