ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ব্যাটারিচালিত রিকশার দখলে ফের রাজধানীর সড়ক

ব্যাটারিচালিত রিকশার দখলে ফের রাজধানীর সড়ক

দেশের মহাসড়ক ও প্রধান প্রধান সড়কে নিষিদ্ধ থাকলেও রাজধানীতে অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। অথচ এসব যান চলাচল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। অলিগলি থেকে শুরু করে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কেই নির্বিঘ্নে চলছে এই বাহন। মাঝে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের অভিযানের ফলে কিছুটা চাপে থাকলেও ফের রাজধানীর সড়ক ব্যাটারিচালিত রিকশার দখলে চলে গেছে। সড়কে ইঞ্জিনচালিত দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। ফলে এসব যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন নগরবাসী।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার বেপরোয়া চলাচলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এতে জীবন কেড়ে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। নগরীর সড়ক ও পরিবহণের শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে সুফল মিলছে না।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিশেষ করে রাজধানীর ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, শাহবাগ, মতিঝিল, পল্টন, তেজগাঁও, খিলগাঁও, মুগদা, বাসাবো, বাড্ডা, রামপুরা, বনশ্রী, কামরাঙ্গিরচরসহ বিভিন্ন এলাকায় অবাধে চলছে এই অটোরিকশা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে রিকশার সংখ্যা কত, এর সঠিক কোনো তথ্য কোনো সংস্থার কাছে নেই। ডিএসসিসি এলাকায় অবৈধ প্রায় ৪ লাখ রিকশা রয়েছে। ডিএনসিসি এলাকায়ও অবৈধ রিকশার সংখ্যা ৪ থেকে ৫ লাখ হবে বলে মনে করছেন ডিএনসিসি সংশ্লিষ্টরা। নতুন করে ঢাকায় যেসব রিকশা নামানো হচ্ছে, এর মধ্যে বড় একটি সংখ্যা ব্যাটারিচালিত। শারীরিক কষ্ট লাঘব করতে রিকশাচালকরা ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। এজন্য রিকশার মালিকরাও রিকশায় ব্যাটারি যুক্ত করছেন।

জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্তমান মেয়র ব্যরিস্টার ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব গ্রহণের পরপর ডিএসসিসি এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা তুলে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিছুদিন অভিযানও পরিচালনা করা হয়। নানামুখী সমালোচনার কারণে ডিএসসিসির এ উদ্যোগের গতি হ্রাস পেয়েছে। কালেভদ্রে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ফলে দেদাচ্ছে মহানগরীর অলিগলি থেকে প্রধান সড়ক পর্যন্ত অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভেতরে মোটরচালিত, মেশিনচালিত, ইঞ্জিনচালিত কিংবা ব্যাটারিচালিত সব ধরনের অটোরিকশা জাতীয় যানবাহন আনুষ্ঠানিক ভাবেও নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৭ সালেও একবার উচ্চ আদালত সড়কে অনুমোদনহীন বা তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও (ডিএনসিসি) ব্যাটারিচালিত রিকশামুক্ত রাজধানী চায়। সে লক্ষ্যে পুলিশকে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা অপসারণে বিভিন্ন সময় অনুরোধ জানিয়েছে। এছাড়া বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভায়ও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা অপসারণে ডিএনসিসির সম্মতি জানিয়েছে বলে জানা যায়। সম্প্রতি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। এর জন্য নগরবাসীর সহযোগিতাও কামনা করেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ২০ শতাংশই ঘটে ব্যাটারিচালিত রিকশায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অবৈধ যান চলছে কীভাবে?

অনুসন্ধানে জানা যায়, এর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে আছে স্থানীয় নেতা, চাঁদাবাজ, এমনকি পুলিশও।

ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা বলছেন, তারা মাসোহারা দিয়ে একটি করে টোকেন নিচ্ছেন, এরপর নির্বিঘেœ চালাচ্ছেন এই অবৈধ যান। বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন সংবলিত টোকেন ধরিয়ে দেয়া হয় তাদের। প্রতি মাসে টোকেন বাবদ ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা নেয়া হয়। এই অনিয়মের পেছনে আছে পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা ও সদস্য জড়িত বলে অভিযোগ আছে। টোকেন দেখাতে পারলে পুলিশ কিছুই বলে না। আর টোকেন না থাকলে জব্দ করে নিয়ে যায় রিকশা। একেকটি রিকশা ছাড়িয়ে আনতে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয়।

এদিকে, করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক অভিঘাতের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের ওপর পড়েছে। কয়েক মাস ধরেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্তের পর এখন সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ ব্যবহার কমানো, জ্বালানি খাতের বাজেট বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম ব্যবহারের ব্যবস্থা করাসহ নতুন করে আরো ৮ দফা সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এই অবস্থার মধ্যেই চলছে বিদ্যুৎচালিত ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইক।

ব্যবসায়ীরাসহ যোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দেশে কমপক্ষে ২০ লাখ এমন পরিবহণ চলছে। যা ২০১৬ সালে ছিল ১০ লাখ। ব্যাটারিচালিত যানবাহনে দিনে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এসব বন্ধে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রশাসন ও স্থানীয় নেতাদের যোগসাজশে চলছে এসব যান। বুয়েটের এক গবেষণা বলছে, সারা দেশে দিনে অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার পেছনে।

২০১৬ সাল থেকে ব্যাটারিচালিত এসব যানবাহনের ওপর গবেষণা করেছেন বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. জিয়াউর রহমান খান। তিনি জানান, দেশে প্রায় ২৯ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত যানবাহনে দিনে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে অন্তত ২ হাজার মেগাওয়াট। একটি ইজিবাইকে ৪-৫টি ব্যাটারি থাকে। ১২ ভোল্টের প্রতিটি ব্যাটারির জন্য ৮০০ থেকে ১ হাজার ১০০ ওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। রাজধানীর আহাম্মদবাগ এলাকার দারোগার বাড়ির মোড়ের গলিপথে বেশ কয়েকটি ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ। এ রকম গ্যারেজের কমতি নেই পাশের মহল্লা থেকে শুরু করে মুগদাপাড়া, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, বাসাবোসহ খিলগাঁও এলাকায়। এ অটোরিকশাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে ব্যবসা করছে। মূলত লাভবান হচ্ছে ফাঁকে ফাঁকে যারা এ ব্যবসা করছে। তারা দেড় থেকে ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাটারি চার্জের জন্য বিদ্যুতের বিশেষ লাইন নামিয়ে চার্জের ব্যবসা করছে।

ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ঢাকায় চালানো নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে চালাচ্ছি। অনেক সময় পুলিশ জরিমানা করে রেকার বিল করে। তারপরও এসব মিটিয়েই চালাতে হয়, তা না হলে ছেলেমেয়েদের খাবার জোটাবো কীভাবে।

অন্যদিকে, ব্যাটারিচালিত সহজ বিধায় এসব পরিবহণের বেশির ভাগ চালক শিশু। যাদের অধিকাংশের বয়স হলো ১৮ বছরের নিচে। তারা হলো শিশুশ্রমের আওতাভুক্ত। যা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। ব্যাটারিচালিত বিধায় তারা এসব পরিবহণ অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। যার কারণে হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেকেই মারা যাচ্ছে আবার অনেকেই জীবনের তরে পঙ্গুত্ব বরণ করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ। ডিএনসিসি থেকে এসব রিকশার অনুমোদন দেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় ডিএনসিসি অবৈধ রিকশার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এসব অবৈধ রিকশা বন্ধে পুলিশেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক), মুনিবুর রহমানের বক্তব্য জানার চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত